বাংলাদেশ

জরুরি অবস্থা আর প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় নয়, লাগবে মন্ত্রিসভার অনুমোদন

Advertisement

বাংলাদেশের সংবিধানে জরুরি অবস্থা ঘোষণা সংক্রান্ত ১৪১ (ক) অনুচ্ছেদে পরিবর্তন আনতে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই এই ধারা রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার হওয়ার অভিযোগে সমালোচিত হয়ে আসছিল। এবার সেই অপব্যবহার ঠেকাতেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ উপস্থাপন এবং প্রাথমিক সম্মতি মিলেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে।

জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বর্তমান সংবিধানের ধারা কী বলে?

বর্তমানে সংবিধানের ১৪১ (ক) এর ১ নম্বর উপধারায় বলা আছে, রাষ্ট্রপতির কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হলে যে দেশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের কারণে হুমকির মুখে পড়েছে, তখন তিনি জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন। এই অবস্থায় জরুরি অবস্থা জারির মেয়াদ সর্বোচ্চ ১২০ দিন পর্যন্ত হতে পারে। তবে এতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর প্রয়োজন।

নতুন প্রস্তাব কী বলছে?

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, এখন থেকে জরুরি অবস্থা জারির পূর্বে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার লিখিত অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হবে। একই সঙ্গে মেয়াদ ১২০ দিনের পরিবর্তে সর্বোচ্চ ৯০ দিন করার সুপারিশ করা হয়েছে।

এছাড়া, অনুচ্ছেদের ভাষাগত দিকেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার প্রস্তাব এসেছে। ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগ’ শব্দগুচ্ছের পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি হুমকি, মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ’— এসব শব্দ অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।

মানবাধিকার রক্ষায় নতুন সুরক্ষা বিধান

জরুরি অবস্থার সময় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার যেন খর্ব না হয়, তা নিশ্চিত করতেও সুপারিশ এসেছে। সংবিধানের ৪৭ (৩) ধারার আলোকে বলা হয়েছে, জরুরি অবস্থার মধ্যেও কোনো নাগরিকের জীবন অধিকার, নির্যাতন বা অমানবিক ও মর্যাদাহানিকর আচরণ থেকে মুক্ত থাকার অধিকার হরণ করা যাবে না।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য

যদিও বেশিরভাগ দল এই প্রস্তাবে একমত পোষণ করেছে, তবুও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা গেছে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রস্তাব করেছেন, মন্ত্রিসভার পরিবর্তে সর্বদলীয় বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হোক। অন্যদিকে, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশের আহমদ আবদুল কাদের দাবি করেছেন, বিরোধীদলকে মন্ত্রিসভার আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব উত্থাপন করেন— জরুরি অবস্থার সিদ্ধান্তে বিরোধী দলীয় নেতা বা নেত্রীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। তার এই প্রস্তাবে সমর্থন জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। পরবর্তীতে ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, বিরোধী দলীয় নেতা অনুপস্থিত থাকলে উপনেতাকে উপস্থিত রাখার সুযোগ থাকতে হবে।

এই প্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার স্পষ্ট করেন, বিরোধী দলীয় উপনেতারও মন্ত্রী পদমর্যাদা রয়েছে, তাই তার উপস্থিতিতেও প্রক্রিয়াটি বৈধ হবে।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কী হলো?

বিভিন্ন প্রস্তাব ও মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত একটি মৌলিক সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এখন থেকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্য প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরের পরিবর্তে মন্ত্রিসভার লিখিত অনুমোদন প্রয়োজন হবে। সেই বৈঠকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বা তার অনুপস্থিতিতে উপনেতার উপস্থিতিও নিশ্চিত করা হবে।

এই পরিবর্তনের গুরুত্ব কতটুকু?

এই পরিবর্তন যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্তকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের সুযোগ অনেকাংশে কমে আসবে। একক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবর্তে সম্মিলিত মত ও সংসদীয় প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে, যা গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবেই বিবেচিত হবে।

সারসংক্ষেপ  

সাম্প্রতিক এই আলোচনা ও প্রস্তাবনাগুলো স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলাদেশ এখন গণতান্ত্রিক নীতির পথে আরও দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হতে চাচ্ছে। সংবিধানের সংশোধনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটছে, যা ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জননিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এম আর এম – ০৩১৫, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button