বাংলাদেশ

ভবনের এক পাশ দিয়ে ঢুকে আরেক পাশে বের হয়ে যায় বিমানটি!

Advertisement

 উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি ভবনের প্রধান ফটক ভেঙে প্রবেশ করে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এ ঘটনায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১৯ জন, আহত বহু। তদন্তে গঠন করা হয়েছে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি।

উত্তরায় ভয়াবহ বিমান বিধ্বস্ত: ভবন ভেদ করে এফোঁড়-ওফোঁড়

রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়িতে সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত বিমানটি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে ভবনের একপাশ দিয়ে গিয়ে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। দৃশ্যটি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, মুহূর্তেই এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ভবনের মাঝখান দিয়ে সজোরে ঢুকে পড়ে বিমানটি এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে বহু মানুষ।

ভবনের মধ্য দিয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো বিমানটি

সরেজমিনে জানা গেছে, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের হায়দার আলী ভবনটি পশ্চিমমুখী, যেখানে মাঝখানে রয়েছে প্রধান ফটক এবং দোতলায় উঠার সিঁড়ি। বিমানটি ঠিক সেই প্রধান ফটক লক্ষ্য করেই ধাক্কা দেয় এবং নিচতলায় থাকা অফিস কক্ষের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে।

ফটক ভেঙে ভবনের কনক্রিট ছিঁড়ে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় বিমানটির কিছু অংশ। এতে ভবনটির একাংশ কার্যত ধসে পড়ে। সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ভেতরে প্রবেশ করে আহতদের উদ্ধার করেন। ভবনের নিচতলায় থাকা কর্মীরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হন।

উড্ডয়নের ১৬ মিনিট পরই বিপর্যয়

বিমান বাহিনী জানিয়েছে, এফ-৭ বিজেআই মডেলের এই প্রশিক্ষণ বিমানটি বেলা ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়ন করে এবং ১টা ২২ মিনিটে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। উড্ডয়নের মাত্র ১৬ মিনিট পরই উত্তরার আবাসিক এলাকার মধ্যবর্তী এই স্কুলে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি।

পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগর একাই বিমানটি চালাচ্ছিলেন। তিনি গুরুতর আহত অবস্থায় সিএমএইচে নেওয়ার পর মৃত্যুবরণ করেন।

উদ্ধার কার্যক্রম: সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও রেড ক্রিসেন্টের সম্মিলিত অভিযান

দুর্ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী, বিজিবি, রেড ক্রিসেন্ট ও পুলিশের যৌথ বাহিনী উদ্ধার অভিযানে নামে।

মাইলস্টোন কলেজের মাঠে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং এরপর দ্রুত বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়।
বার্ন ইনস্টিটিউটে ৪৮ জন দগ্ধ রোগী ভর্তি হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। উত্তরা আধুনিক হাসপাতাল, সিএমএইচ, কুর্মিটোলা ও ঢাকা মেডিকেল কলেজেও রোগীদের ভর্তি করা হয়েছে।

প্রাণহানি ও আহতের সংখ্যা

সর্বশেষ পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এ দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এবং দেড় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।

নিহতদের মধ্যে স্কুলের কর্মী, শিক্ষার্থী ও সাধারণ পথচারীও রয়েছেন। আহতদের মধ্যে অনেকেই ভবনের নিচতলায় অবস্থান করছিলেন, যাদের অধিকাংশই চরমভাবে দগ্ধ হয়েছেন।

অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। দুর্ঘটনার সময় ভবনের আশপাশে থাকা অভিভাবকরাও দুর্ঘটনার কবলে পড়েন।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আতঙ্ক ও কান্না

ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা চিৎকার করে কান্না করতে থাকে। অনেকে দৌড়ে স্কুল ভবনের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। ফটকের সামনে দাঁড়ানো বহু অভিভাবক তাদের সন্তানদের খোঁজে উদ্গ্রীব হয়ে পড়ে।

একজন অভিভাবক বলেন, “আমি এসেছিলাম মেয়েকে আনতে, হঠাৎ দেখি বিকট আওয়াজ, এরপর চারপাশে শুধু ধোঁয়া আর আগুন।”

আরেক শিক্ষার্থী জানায়, “আমরা ক্লাসে ছিলাম, হঠাৎ বিকট শব্দে সব কেঁপে উঠল। তারপর সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করল।”

সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া

প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। সামরিক বাহিনী, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এছাড়াও মঙ্গলবার (২২ জুলাই) একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিসে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য ও নিরাপত্তা প্রশ্ন

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের মতে, যেকোনো প্রশিক্ষণ বিমানের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে পাইলটের প্রশিক্ষণ, বিমানটির রক্ষণাবেক্ষণ ও আবহাওয়ার প্রভাব বিবেচনায় রাখতে হয়। এমন জনবহুল এলাকায় বিমান বিধ্বস্ত হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক এবং উদ্বেগজনক বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।

তাদের মতে, ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণ বিমানের রুট পরিকল্পনায় জনবসতিপূর্ণ এলাকার ঝুঁকি মূল্যায়ন জরুরি।

পরবর্তী পদক্ষেপ 

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে নতুন নীতিমালা প্রণয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। সরকার জানিয়েছেন, আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হবে এবং নিহতদের পরিবারকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে শুধু প্রযুক্তিগত নয়, নীতিগত ও পরিবেশগত দিকগুলোও বিবেচনায় নেওয়া দরকার।


উত্তরার একটি স্কুলের ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে যেভাবে ভবন ভেদ করে অপর পাশে বেরিয়ে গেছে, তা এই দুর্ঘটনার ভয়াবহতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এই মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে — এটাই এখন জাতির প্রত্যাশা।

এম আর এম – ০৪৪১, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button