বিশ্ব

১৪ বছর পর বহির্বিশ্বে তেল রফতানি শুরু করল সিরিয়া

দীর্ঘ ১৪ বছরের অপেক্ষার পর সিরিয়া আবারও আন্তর্জাতিক বাজারে তেল রফতানি শুরু করেছে। সোমবার (১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫) দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় তারতুস বন্দর থেকে প্রায় ৬ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল বহির্বিশ্বে রফতানি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন সিরিয়ার জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।

এই রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করেছে বি সার্ভ এনার্জি (B Serve Energy) নামে একটি আন্তর্জাতিক তেল ও গ্যাস ট্রেডিং কোম্পানি। এটি সিরিয়ার জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, কারণ ২০১১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির তেল রফতানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

সিরিয়ার তেল রফতানির ইতিহাস: সোনালী যুগ থেকে ধ্বংসস্তূপে

সিরিয়া একসময় মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০১০ সালে দেশটি প্রতিদিন গড়ে ৩ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রফতানি করত। এই তেল বিক্রি থেকে সিরিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার বড় অংশ অর্জিত হতো, যা অর্থনীতির অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল।

কিন্তু ২০১১ সালে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ, সন্ত্রাসবাদ, বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থান এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে তেল খাত সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ এবং মার্কিন-ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞা তেল রফতানি কার্যক্রম সম্পূর্ণ স্থবির করে দেয়।

কুর্দি নিয়ন্ত্রিত তেলক্ষেত্রের দখল

সিরিয়ার সবচেয়ে বড় তেলক্ষেত্রগুলো মূলত দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত, যা বর্তমানে কুর্দি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। মার্কিন বাহিনীও ওই অঞ্চলে অবস্থান করছে, ফলে সিরিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার দীর্ঘ সময় ধরে এসব তেলক্ষেত্র থেকে তেল উত্তোলন ও রফতানি করতে পারেনি।

কেন বন্ধ হয়েছিল তেল রফতানি?

তেল রফতানি বন্ধ হওয়ার প্রধান কারণ ছিল আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। ২০১১ সালের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কিছু আরব দেশ সিরিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর মধ্যে ছিল:

  • তেল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা
  • আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং লেনদেন বন্ধ
  • জ্বালানি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল
  • বিদেশি বিনিয়োগ বন্ধ

ফলে সিরিয়া তেল উৎপাদন করলেও সেটি আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করতে পারত না। দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত তেলের পরিমাণও যুদ্ধের কারণে ব্যাপকভাবে কমে যায়।

নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার: কিভাবে সম্ভব হলো তেল বাণিজ্য পুনরায় শুরু করা?

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু পশ্চিমা দেশ সিরিয়ার ওপর থেকে কিছু অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। মূলত মানবিক সংকট মোকাবিলা এবং মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তাছাড়া, রাশিয়া, ইরান এবং চীন সিরিয়ার প্রধান মিত্র হিসেবে দেশটির পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখছে। সিরিয়া এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক তেল বাজারে প্রবেশের চেষ্টা করছে।

প্রথম রফতানি কার কাছে গেল?

প্রথম দফায় সিরিয়া তারতুস বন্দর থেকে প্রায় ৬ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রফতানি করেছে। তেলের গন্তব্যস্থল সম্পর্কে সরকার কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, এটি মূলত এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশের কাছে যাচ্ছে।

চুক্তি সম্পাদন করেছে বি সার্ভ এনার্জি, যা একটি বিশ্বব্যাপী তেল ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান। ধারণা করা হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে, কারণ সিরিয়ার সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্য করতে অনেক দেশ এখনও অনিচ্ছুক।

বিশ্ব তেল বাজারে এর প্রভাব কী হতে পারে?

২০২৫ সালে বৈশ্বিক তেল বাজার এখনও অস্থির। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা, ওপেক দেশগুলোর উৎপাদন হ্রাস—সবকিছু মিলিয়ে তেলের দাম ওঠানামা করছে। সিরিয়ার তেল রফতানি পুনরায় শুরু হলে বৈশ্বিক তেল বাজারে স্বল্পমেয়াদে বড় প্রভাব পড়বে না, কারণ এর উৎপাদন এখনও সীমিত।

তবে দীর্ঘমেয়াদে যদি সিরিয়া পুনরায় প্রতিদিন ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ ব্যারেল রফতানি করতে সক্ষম হয়, তবে মধ্যপ্রাচ্যের তেল বাজারে নতুন সমীকরণ তৈরি হবে।

অর্থনৈতিক সুবিধা: সিরিয়ার জন্য নতুন আশার আলো

তেল রফতানি পুনরায় শুরু হওয়া সিরিয়ার জন্য বড় অর্থনৈতিক স্বস্তি। দীর্ঘ ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধ ও ধ্বংসের পর দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। তেল বিক্রি থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রা অবকাঠামো পুনর্গঠন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং মানবিক সহায়তায় কাজে লাগানো হবে বলে জানিয়েছে সরকার।

চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে

তবে সবকিছু এতটা সহজ নয়। সিরিয়াকে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে:

  • কুর্দি নিয়ন্ত্রিত তেলক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ ফেরত পাওয়া
  • আন্তর্জাতিক বাজারে স্থায়ী অবস্থান তৈরি করা
  • অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ
  • বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা
  • সম্ভাব্য নতুন নিষেধাজ্ঞা এড়ানো

বিশেষজ্ঞদের মতামত

আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, “সিরিয়ার তেল রফতানি পুনরায় শুরু হওয়া ইতিবাচক হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বৈশ্বিক তেল বাজারে বড় কোনো পরিবর্তন আনবে না। তবে সিরিয়ার অর্থনীতির জন্য এটি গেমচেঞ্জার হতে পারে।”

ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী?

সিরিয়ার সরকার জানিয়েছে, আগামী দুই বছরের মধ্যে তারা উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুণ করতে চায়। এর জন্য নতুন বিনিয়োগ, প্রযুক্তি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

MAH – 12614,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button