বাংলাদেশ

নিবন্ধন ফিরে পেল জামায়াতে ইসলামী, প্রতীক নির্ধারণে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি

দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে অবশেষে নিবন্ধন ফিরে পেল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রোববার (১ জুন) এক ঐতিহাসিক রায়ে হাইকোর্টের পূর্ববর্তী রায় বাতিল ঘোষণা করে দলটির নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) নির্দেশ দিয়েছেন। তবে দলটির ঐতিহ্যবাহী প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ পুনরায় বরাদ্দ দেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে ইসি নিজেই।

এই রায় প্রদানের মাধ্যমে এক যুগের বেশি সময় ধরে চলা জামায়াতের নিবন্ধনসংক্রান্ত জটিলতার অবসান হলো। আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দলটির নিবন্ধন আইনগতভাবে বৈধ এবং এটি আবার কার্যকর করার ক্ষেত্রে আর কোনো বাধা থাকছে না।

রায়ের পেছনের প্রেক্ষাপট

২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন গ্রহণ করে। কিন্তু ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে দলটির নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করেন। এরপর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর ইসি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে।

এই রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী আপিল করলেও নানা কারণে শুনানি বিলম্বিত হয়। বিশেষ করে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে আপিল বিভাগে মূল আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় আদালত ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ বলে আপিল খারিজ করে দেয়। এর ফলে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে এবং দলটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।

তবে এরপর জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে খারিজ হওয়া আপিল পুনরুজ্জীবিত করার আবেদন করা হয়। সর্বোচ্চ আদালত সেই আবেদন গ্রহণ করে এবং ২০২৪ সালের ১২ মার্চ থেকে শুনানি শুরু হয়, যা ১৪ মে শেষ হয়। এই সময়ের মধ্যেই রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক দিক থেকে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় জামায়াতের নিবন্ধন ইস্যু।

রায়ের বিস্তারিত ও আদালতের পর্যবেক্ষণ

প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ রোববার এই রায় ঘোষণা করেন। এই বেঞ্চে আরও ছিলেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।

রায়ে আদালত হাইকোর্টের পূর্বের রায়কে বাতিল ঘোষণা করে বলেন, “রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন একটি সাংবিধানিক অধিকার। আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে এবং অবাধ রাজনৈতিক চর্চা নিশ্চিত করতেই এই আদেশ দেওয়া হয়েছে।”

আদালত আরও বলেন, “নিবন্ধন না থাকলে কোনো দল সাংবিধানিকভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। তাই একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করা হলে তা অবশ্যই সুস্পষ্ট আইনি প্রক্রিয়ায় হতে হবে। এ ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী আদেশ আইনি বিচারের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেনি।”

আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া

রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামী পক্ষে থাকা আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, “আজকের রায়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের আইনি লড়াইয়ের অবসান হলো। রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জামায়াতের নিবন্ধন কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। আজকের রায় প্রমাণ করেছে, আইন ও বিচার ব্যবস্থায় এখনো ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব।”

তিনি আরও জানান, “আমরা আদালতের শর্ট অর্ডার হাতে পাওয়ার পর তা নির্বাচন কমিশনে জমা দেব। এরপর ইসি আইন অনুযায়ী নিবন্ধন এবং প্রতীকের বিষয়টি নিষ্পত্তি করবে।”

আইনজীবী ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিক ও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিকও আদালতে জামায়াতের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। তাদের মতে, “এটি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলের বিজয় নয়, বরং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ জয়।”

ইসির করণীয়: প্রতীকের প্রশ্নে অনিশ্চয়তা

যদিও আপিল বিভাগের রায়ে দলটির নিবন্ধন পুনর্বহালের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তবে দলের প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ দেওয়া হবে কিনা তা নির্ভর করছে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের ওপর। কারণ ইসি চাইলে প্রতীকটি আগের মতো দিতে পারে, কিংবা পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে নতুন প্রতীক বরাদ্দ করতে পারে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর বিষয়টি কমিশনের পরবর্তী বৈঠকে আলোচিত হবে। তখন আইন পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রতীক সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

জামায়াত নেতাদের উপস্থিতি ও প্রতিক্রিয়া

রায়ের সময় সুপ্রিম কোর্টে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, মোবারক হোসেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, উত্তরের আমির মো. সেলিম উদ্দিন এবং ড. হেলাল উদ্দিন।

তারা রায়কে গণতন্ত্রের বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং বলেন, “জামায়াত নির্বাচনমুখী দল। আমরা সবসময় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেছি। এবার নিবন্ধন ফিরে পেয়ে আমরা আবারো জনগণের সেবায় কাজ করব।”

রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ প্রভাব

জামায়াতের নিবন্ধন ফিরে পাওয়াকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত অংশ নিতে পারলে নির্বাচনী রাজনীতিতে একধরনের ভারসাম্য ফিরে আসবে।

অপরদিকে, জামায়াতের নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার বিরোধিতা করে আসা বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগঠন কী প্রতিক্রিয়া জানাবে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারণ, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পেছনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার অভিযোগও ছিল অন্যতম কারণ।

এক দশকেরও বেশি সময় পর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফিরে পাওয়া দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই রায়ের মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে একটি নতুন অধ্যায় শুরু হলো। এখন দেখার বিষয়, নির্বাচন কমিশন প্রতীকের বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নেয় এবং জামায়াত কীভাবে নির্বাচনী রাজনীতিতে নিজেদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button