
আগামী ১০ জুন ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচ ঘিরে ফুটবলপ্রেমীদের উত্তেজনা তুঙ্গে। চার বছর পর সংস্কারের মাধ্যমে নতুনভাবে সাজানো জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিতব্য এই আন্তর্জাতিক ম্যাচে হামজা চৌধুরী, শমিত সোম, এবং ফাহামিদুলের মতো তারকা খেলোয়াড়দের খেলা দেখার সুযোগ নিয়ে দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ আকাশচুম্বী। তবে, এই ম্যাচের টিকিট বিক্রির প্রক্রিয়া ফুটবলপ্রেমীদের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী শনিবার (২৪ মে) রাত ৮টা থেকে টিকিট বিক্রি শুরুর কথা থাকলেও, প্রযুক্তিগত ত্রুটি ও সাইবার হামলার কারণে টিকিট বিক্রি এখনো শুরু হয়নি। এই বিশৃঙ্খলা ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা সৃষ্টি করেছে।
টিকিট বিক্রির প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা
বাফুফে আগেই ঘোষণা করেছিল যে, টিকিট বিক্রি হবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম tickify.live এর মাধ্যমে। ২৪ মে রাত ৮টা থেকে টিকিট বিক্রি শুরুর কথা থাকলেও, নির্ধারিত সময়ে ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা দর্শকদের অনেকেই ‘503 Service Temporarily Unavailable’ বার্তার সম্মুখীন হন। এই প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে অধিকাংশ দর্শক টিকিট কিনতে ব্যর্থ হন। ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে হামজা চৌধুরী ও শমিত সোমের ঘরের মাঠে অভিষেক ম্যাচ নিয়ে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছিল, তা যেন টিকিট বিক্রির এই বিশৃঙ্খলার কারণে ম্লান হয়ে গেছে।
শনিবার রাতেই বাফুফে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, tickify.live ওয়েবসাইট ‘সাইবার হামলার’ শিকার হয়েছে। এই অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে তারা জানায়, শীঘ্রই টিকিট বিক্রির সর্বশেষ অবস্থা জানানো হবে। তবে, প্রায় ২৪ ঘণ্টা পার হলেও ২৫ মে রাত ১০টা পর্যন্ত টিকিট বিক্রি শুরু হয়নি। বাফুফের কম্পিটিশন কমিটির সদস্য তাজওয়ার আউয়াল জানান, ওয়েবসাইটে দ্বিতীয়বারের মতো সাইবার হামলা হয়েছে। তিনি বলেন, “শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত টিকিট বিক্রি শুরু করা হবে না। প্রথম ১০ মিনিটেই ১ লাখের বেশি ব্যবহারকারী লগইন করেছেন, যেখানে টিকিট ছিল মাত্র ১৮,৩০০টি। দুই দফায় সাইবার হামলার কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।”
টিকিট বিক্রির পরিসংখ্যান নিয়ে বিভ্রান্তি
টিকিট বিক্রির সংখ্যা নিয়ে বাফুফের কর্মকর্তাদের বক্তব্যে অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গেছে। একটি সাইবার নিরাপত্তা সংস্থা দাবি করেছে, tickify.live প্ল্যাটফর্মে একসঙ্গে চার লাখ ব্যবহারকারী প্রবেশ করতে পারে। তবে শনিবার সর্বোচ্চ ৯,৭৮১ জন ব্যবহারকারী লগইন করেছিলেন, অথচ ১৭,০০০-এর বেশি টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে বলে তাদের দাবি। এই সংস্থার ভাষ্য, হ্যাকাররা সার্ভারে প্রবেশ করে টিকিট কালোবাজারে বিক্রি করছে।
অন্যদিকে, বাফুফের কম্পিটিশন কমিটির চেয়ারম্যান গোলাম গাউস দাবি করেন, “গ্যালারি ও ক্লাব হাউস মিলিয়ে ১৮,৩০০টি টিকিট ছাড়া হয়েছে, ভিআইপি বক্সসহ মোট টিকিট ২০,০০০-এর বেশি। শনিবার অনলাইনে মাত্র ৭,০০০ টিকিট বিক্রি হয়েছে।” তবে তাজওয়ার আউয়ালের বক্তব্য ভিন্ন। তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত মাত্র ৩,৫০০ টিকিট বিক্রি হয়েছে।” এই পরস্পরবিরোধী তথ্য দর্শকদের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়িয়েছে।
দর্শকদের হতাশা ও উদ্বেগ
টিকিট বিক্রির এই বিশৃঙ্খলার কারণে ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকে টাকা পরিশোধ করেও ই-মেইলে টিকিট পাননি। এই পরিস্থিতিতে ম্যাচের দিন স্টেডিয়ামে গিয়ে তারা বিপাকে পড়বেন কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বাফুফে আশ্বাস দিয়েছে, যারা ঠিকভাবে টাকা পরিশোধ করেছেন, তারা টিকিট পাবেন এবং সব ভুলভ্রান্তি সংশোধন করা হবে। তাজওয়ার আউয়াল বলেন, “আমরা পুরোপুরি সমস্যার সমাধান করে টিকিট বিক্রি শুরু করব। যারা টাকা দিয়েছেন, তাদের টিকিট নিশ্চিত করা হবে।”
বাফুফের অভিজ্ঞতার অভাব
বাফুফের জন্য সম্পূর্ণ অনলাইনে টিকিট বিক্রি একটি নতুন অভিজ্ঞতা। এর আগে তারা কখনো কোনো ম্যাচের সব টিকিট অনলাইনে বিক্রি করেনি। ফুটবল বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাফুফে এই প্রক্রিয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়নি। আগামী ৪ জুন বাংলাদেশ-ভুটান প্রীতি ম্যাচের টিকিট অনলাইনে বিক্রি করে পরীক্ষামূলকভাবে প্রক্রিয়াটি যাচাই করে নিতে পারত। কিন্তু বাফুফে সরাসরি ১০ জুনের ম্যাচের টিকিট বিক্রি শুরু করেছে, যা এই বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্লেষকরা আরও মনে করেন, tickify.live প্ল্যাটফর্মের সক্ষমতা যাচাই না করেই তাদের টিকিট বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। একটি সাইবার নিরাপত্তা সংস্থার দাবি, প্ল্যাটফর্মটির সার্ভারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না, যার ফলে সাইবার হামলা ঘটেছে। এই ঘটনা বাফুফের পরিকল্পনার ঘাটতি এবং প্রযুক্তিগত দুর্বলতাকে সামনে এনেছে।
টিকিটের মূল্য ও প্রত্যাশা
বাফুফে জানিয়েছে, ম্যাচের জন্য মোট ১৮,৩০০টি টিকিট বিক্রি হবে, যা ৯টি ক্যাটাগরিতে বিভক্ত। সাধারণ গ্যালারির টিকিটের মূল্য ৪০০ টাকা, ক্লাব হাউজ-২ এর টিকিট ২,০০০ টাকা, ক্লাব হাউজ-১, ভিআইপি-২ ও ৩ এর টিকিট ২,৫০০ টাকা, স্কাই ভিউ ৩,০০০ টাকা, ভিআইপি বক্স-১ এর টিকিট ৪,০০০ টাকা এবং করপোরেট ও হসপিটালিটি বক্সের টিকিট ৫,০০০ টাকা। এই মূল্য নির্ধারণ নিয়ে দর্শকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে মনে করেন, সাধারণ গ্যালারির টিকিটের মূল্য আরও কম হওয়া উচিত ছিল, যাতে বেশি সংখ্যক দর্শক মাঠে উপস্থিত থাকতে পারেন।
সমাধানের পথে বাফুফে
বাফুফের কম্পিটিশন কমিটির চেয়ারম্যান গোলাম গাউস বলেন, “গতকাল সারা রাত আমরা কাজ করেছি। tickify কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই টিকিট বিক্রি শুরু হবে।” তিনি আরও জানান, রাতের মধ্যেই টিকিট বিক্রির নতুন সময়সূচি বাফুফের ফেসবুক পেজে প্রকাশ করা হবে। তবে, নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করতে পারেননি তিনি।
এদিকে, বাফুফের সহ-সভাপতি ফাহাদ করিম এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি গোলাম গাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। ফুটবলপ্রেমীরা এখন অপেক্ষায় আছেন বাফুফের পরবর্তী ঘোষণার জন্য।
উপসংহার
বাংলাদেশ-সিঙ্গাপুর ম্যাচের টিকিট বিক্রির বিশৃঙ্খলা ফুটবলপ্রেমীদের উৎসাহে ছেদ পড়েছে। বাফুফের অপরিকল্পিত পদক্ষেপ এবং tickify.live প্ল্যাটফর্মের প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। তবে, বাফুফে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে। ফুটবলপ্রেমীরা এখন অপেক্ষায় আছেন, কবে তারা টিকিট কিনে হামজা চৌধুরী ও শমিত সোমের খেলা মাঠে বসে উপভোগ করতে পারবেন। এই ঘটনা বাফুফের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে আরও পরিকল্পিত ও সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেওয়া হয়।