খেলা

মোস্তাফিজ নিলেন ৩ উইকেট, ভাঙলেন সাকিবের রেকর্ড

বাংলাদেশের ক্রিকেট তারকা মোস্তাফিজুর রহমান আইপিএলের মঞ্চে আরেকটি ইতিহাস রচনা করলেন। জয়পুরের সওয়াই মানসিং স্টেডিয়ামে পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে খেলতে নেমে তিনি ৩ উইকেট শিকার করে সাকিব আল হাসানের দীর্ঘদিনের রেকর্ড ভেঙেছেন। এই ম্যাচে মোস্তাফিজের দুর্দান্ত বোলিং প্রদর্শন তাকে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে আইপিএলে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির আসনে বসিয়েছে। ৬০ ইনিংসে ৬৫ উইকেট নিয়ে তিনি এখন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বোলার হিসেবে আইপিএলের ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন।

ম্যাচের উত্তেজনা ও মোস্তাফিজের প্রভাব

জয়পুরের সওয়াই মানসিং স্টেডিয়ামে পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে এই ম্যাচটি ছিল দিল্লি ক্যাপিটালসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাঞ্জাব কিংস প্রথমে ব্যাট করে ৮ উইকেট হারিয়ে ২০৬ রানের একটি চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়ে। মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর চার ওভারের স্পেলে ৩৩ রান দিয়ে ৩ উইকেট শিকার করেন, যার মধ্যে দুটি উইকেট এসেছে ডেথ ওভারে। তাঁর এই পারফরম্যান্স দিল্লির বোলিং আক্রমণকে শক্তিশালী করেছে এবং পাঞ্জাবের রানের গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ম্যাচের শুরুতেই মোস্তাফিজ তাঁর প্রথম ওভারের পঞ্চম বলে পাঞ্জাবের ওপেনার প্রিয়াংশ আর্যকে আউট করে সাকিবের ৬৩ উইকেটের রেকর্ডে পৌঁছে যান। এরপর ইনিংসের ১৬তম ওভারে শশাঙ্ক সিংকে ফিরিয়ে তিনি সাকিবের রেকর্ড ভেঙে দেন। শেষ ওভারে মার্কো ইয়ানসেনের উইকেট নিয়ে তিনি তাঁর উইকেট সংখ্যা ৬৫-এ নিয়ে যান। তিনটি উইকেটই ক্যাচ আউটের মাধ্যমে এসেছে, এবং তিনটি ক্যাচই নিয়েছেন দিল্লির ফিল্ডার ট্রিস্টান স্টাবস।

সাকিবের রেকর্ড ও মোস্তাফিজের মাইলফলক

সাকিব আল হাসান, বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার, আইপিএলে ৭১ ম্যাচে ৭০ ইনিংস খেলে ৬৩ উইকেট শিকার করেছিলেন। এটি ছিল বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে আইপিএলে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড। তবে মোস্তাফিজুর রহমান মাত্র ৬০ ইনিংসে এই রেকর্ড ভেঙে দিয়েছেন, যা তাঁর দক্ষতা ও ধারাবাহিকতার প্রমাণ। মোস্তাফিজের এই কীর্তি তাঁর ক্যারিয়ারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক, যা বাংলাদেশের ক্রিকেট ভক্তদের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করেছে।

মোস্তাফিজের এই অর্জন শুধু সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাঁর বোলিং শৈলী, বিশেষ করে তাঁর বিখ্যাত ‘কাটার’ এবং ধীরগতির ডেলিভারি, তাকে আইপিএলের মতো প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে একজন অপ্রতিরোধ্য বোলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই ম্যাচে তিনি ডেথ ওভারে দুটি উইকেট নিয়ে প্রমাণ করেছেন কেন তাকে ‘দ্য ফিজ’ বলা হয়। তাঁর বোলিং ইকোনমি ছিল ৮.২৫, যা আইপিএলের মতো উচ্চ-স্কোরিং ম্যাচে অত্যন্ত প্রশংসনীয়।

ম্যাচের ফলাফল ও দিল্লির পারফরম্যান্স

পাঞ্জাব কিংসের দেওয়া ২০৭ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে দিল্লি ক্যাপিটালস ৩ বল বাকি থাকতেই ৬ উইকেটে জয় তুলে নেয়। দিল্লির ব্যাটিং লাইনআপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখানোর পাশাপাশি মোস্তাফিজের বোলিং এই জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদিও দিল্লি ১৪ ম্যাচে ১৫ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম স্থানে থেকে এবারের আইপিএল শেষ করেছে, তবু মোস্তাফিজের এই পারফরম্যান্স তাঁর দলের জন্য একটি স্মরণীয় মুহূর্ত তৈরি করেছে।

মোস্তাফিজ এই মৌসুমে দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলে ৪ উইকেট শিকার করেছেন। এর আগে তিনি চেন্নাই সুপার কিংস, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স, এবং রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে খেলেছেন এবং মোট ৬০ ম্যাচে ৬৫ উইকেট শিকার করেছেন। তাঁর এই ধারাবাহিকতা তাকে আইপিএলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য পেসার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মোস্তাফিজের আইপিএল যাত্রা

মোস্তাফিজুর রহমান ২০১৬ সালে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে আইপিএলে অভিষেক করেন। প্রথম মৌসুমেই তিনি ১৬ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে সবাইকে চমকে দেন এবং দলকে শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর ইকোনমি রেট ছিল মাত্র ৬.৯০, যা তাঁর নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের প্রমাণ। এরপর তিনি মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স, রাজস্থান রয়্যালস, দিল্লি ক্যাপিটালস এবং চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে খেলেছেন। গত মৌসুমে চেন্নাইয়ের হয়ে ৯ ম্যাচে ১৪ উইকেট নিয়ে তিনি দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বোলার ছিলেন।

২০২৫ আইপিএলের নিলামে মোস্তাফিজ প্রথমে কোনো দল থেকে ডাক পাননি। তবে মিচেল স্টার্কের শূন্যতা পূরণে দিল্লি ক্যাপিটালস তাঁকে ৬ কোটি রুপিতে দলে ভিড়িয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিয়েছেন। তাঁর বোলিং অ্যাকশন এবং কাটারের বৈচিত্র্য তাকে আইপিএলের মতো প্রতিযোগিতায় অনন্য করে তুলেছে।

সাকিবের সঙ্গে তুলনা

সাকিব আল হাসান এবং মোস্তাফিজুর রহমান দুজনেই বাংলাদেশ ক্রিকেটের দুই স্তম্ভ। সাকিব তাঁর অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তবে মোস্তাফিজ তাঁর বিশেষায়িত বোলিং দক্ষতার মাধ্যমে আইপিএলে একটি আলাদা ছাপ রেখেছেন। সাকিব ৭১ ম্যাচে ৬৩ উইকেট নিয়েছেন, যেখানে মোস্তাফিজ মাত্র ৬০ ম্যাচে ৬৫ উইকেট নিয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে গেছেন। এই অর্জন মোস্তাফিজের ধারাবাহিকতা এবং দক্ষতার প্রমাণ।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

মোস্তাফিজের এই রেকর্ড তাঁকে আইপিএলের পরবর্তী মৌসুমে আরও বেশি চাহিদা তৈরি করবে। তাঁর বোলিং শৈলী, বিশেষ করে ধীরগতির কাটার এবং ডেথ ওভারে নিয়ন্ত্রণ, তাঁকে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এছাড়া, তিনি পাকিস্তান সুপার লিগের (পিএসএল) ড্রাফটেও নাম লিখিয়েছেন, যা তাঁর বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তার ইঙ্গিত দেয়।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) মোস্তাফিজকে আইপিএলের জন্য এনওসি দিয়েছে, তবে শর্তসাপেক্ষে তাঁকে ২৬ মে’র মধ্যে পাকিস্তানে জাতীয় দলের সঙ্গে যোগ দিতে হবে। এই ব্যস্ত সূচির মধ্যেও মোস্তাফিজ তাঁর পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন, যা তাঁর পেশাদারিত্বের প্রমাণ।

উপসংহার

মোস্তাফিজুর রহমানের এই অর্জন বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য একটি গর্বের মুহূর্ত। তাঁর বোলিং দক্ষতা এবং রেকর্ড ভাঙার ক্ষমতা তাঁকে বিশ্ব ক্রিকেটে একটি উজ্জ্বল নাম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পাঞ্জাব কিংসের বিপক্ষে তাঁর এই পারফরম্যান্স কেবল একটি ম্যাচের জয় নয়, বরং বাংলাদেশের ক্রিকেটের সম্ভাবনার একটি প্রতিফলন। মোস্তাফিজের এই যাত্রা ভক্তদের জন্য উৎসাহের উৎস এবং তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য অনুপ্রেরণা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button