ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে চলমান দুর্নীতির মামলার প্রক্রিয়া নতুন মোড় নিয়েছে। বিচারিক রায় ঘোষণার আগেই তিনি রাষ্ট্রপতি আইজ্যাক হারজগের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন জমা দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এক বিবৃতিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে এবং আবেদনটিকে “ব্যতিক্রমী ও বিশেষ গুরুত্বসম্পন্ন” বলে উল্লেখ করেছে।
৩০ নভেম্বর আল–জাজিরা প্রকাশিত এক বিশদ প্রতিবেদনে এই ঘটনাকে ইসরাইলি রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও নজিরবিহীন অধ্যায় হিসেবে তুলে ধরা হয়।
এই ক্ষমা আবেদনকে কেন্দ্র করে ইসরাইলের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা, সমালোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। কারণ সাধারণত আদালতের রায় ঘোষণার পরই শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি ক্ষমা ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু নেতানিয়াহু বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন সময়েই রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে বসেছেন—যা ইসরাইলের রাজনীতিতে প্রায় নজিরবিহীন।
ক্ষমা আবেদনে কী লিখেছেন নেতানিয়াহু?
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে জমা দেওয়া চিঠিতে নেতানিয়াহু উল্লেখ করেন—
“ক্ষমা প্রাপ্ত হলে আমি ইসরাইলকে এই সংকটময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথে নেতৃত্ব দিতে সর্বোচ্চ সময় ও শক্তি ব্যয় করতে পারব। দেশের অভ্যন্তরীণ বিভাজন কমাতে, চলমান উত্তেজনার অবসান ঘটাতে এবং জাতীয় ঐক্য পুনর্গঠনে এই সিদ্ধান্ত সহায়ক হবে।”
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে—
“রাষ্ট্রের সামনে যেসব বড় চ্যালেঞ্জ—নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট—সেগুলো মোকাবিলা করতে পুরো সামর্থ্য নিয়ে কাজ করতে পারব। ক্ষমা প্রাপ্তি জাতীয় শক্তিকে আরও সুসংহত করবে।”
রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের অবস্থান
রাষ্ট্রপতি আইজ্যাক হারজগের কার্যালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে—
- আবেদনটি অত্যন্ত সংবেদনশীল
- এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা
- রাষ্ট্রপতি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত নিচ্ছেন
- চিঠিটি গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা করা হচ্ছে
তবে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত বা দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়—
“রাষ্ট্রপতি দায়িত্বশীলতা ও সততার সঙ্গে আবেদনটি পর্যালোচনা করছেন। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে।”
দুর্নীতির মামলাগুলোর পটভূমি
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি বড় দুর্নীতির মামলা রয়েছে, যেগুলোতে অভিযোগ করা হয়েছে—
১. ঘুষ গ্রহণ
কিছু ধনী ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মূল্যবান উপহার গ্রহণ এবং এর বিনিময়ে নীতিগত সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
২. জালিয়াতি ও বিশ্বাসভঙ্গ
সরকারি দায়িত্ব ও পদমর্যাদা ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সুবিধা নেওয়ার অভিযোগে আলাদা দুটি মামলা করা হয়েছে।
৩. গণমাধ্যম প্রভাবিত করার অভিযোগ
নির্দিষ্ট কিছু গণমাধ্যমকে সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার অভিযোগও রয়েছে।
এই তিন মামলাকে একত্রে ইসরাইলি রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুর্নীতির মামলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০১০-এর দশকের শেষ দিকেই অভিযোগগুলো প্রকাশ্যে আসে এবং ২০২০ সালে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়। কিন্তু রাজনৈতিক উত্তেজনা, নির্বাচন, সরকার পরিবর্তন এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতির কারণে বিচারপ্রক্রিয়া বারবার বিলম্বিত হয়।
কেন এই ক্ষমা আবেদন “বিরল”?
ইসরাইলের আইন অনুযায়ী—
- সাধারণত আদালত রায় দেওয়ার পরই রাষ্ট্রপতি ক্ষমা ঘোষণা করতে পারেন।
- বিচারপ্রক্রিয়া চলাকালীন সময় ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় না।
কিন্তু নেতানিয়াহু যেভাবে বিচার চলার মাঝামাঝি আবেদন করেছেন, তা প্রায় নজিরবিহীন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন—
- নেতানিয়াহু হয়তো রায়ের সম্ভাব্য দিক বুঝতে পেরেছেন
- রাজনৈতিক ভবিষ্যত রক্ষায় তিনি “আগাম সুরক্ষা” চাইছেন
- ক্ষমতার স্থিতি ধরে রাখতে এই আবেদন একটি কৌশলও হতে পারে
ইসরাইলি রাজনীতিতে নেতানিয়াহুর অবস্থান ও বিতর্ক
ইসরাইলে নেতানিয়াহু একজন দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
- তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন
- বর্তমানে তিনি ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ক্ষমতাসীন নেতা
- নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তার কঠোর অবস্থান নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে
দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে তার জনপ্রিয়তা ওঠা–নামা করছে।
তার বিরুদ্ধে বড় সমালোচনা হয়—
- ন্যায়বিচারের পথে বাধা সৃষ্টি
- বিচার বিভাগকে দুর্বল করার চেষ্টা
- রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যবহার
এছাড়া দেশটির ভেতরে বিভিন্ন সময় বিক্ষোভ, বিচার বিভাগ সংস্কার নিয়ে উত্তেজনা, এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনও দেখা গেছে।
ক্ষমা পাওয়া কি সম্ভব? আইন কী বলে?
ইসরাইলের আইনে রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে—
রাষ্ট্রপতি পারেন:
- দণ্ড মওকুফ করতে
- শাস্তি লাঘব করতে
- আদালতের রায়ের পর পূর্ণ ক্ষমা দিতে
কিন্তু রায় ঘোষণার আগে ক্ষমা দেওয়া?
এই ধরণের ঘটনা প্রায় শোনা যায় না।
তবে আইনে সরাসরি নিষেধ নেই যে রায়ের আগে ক্ষমা দেওয়া যাবে না।
সুতরাং আইনগতভাবে রাষ্ট্রপতি চাইলে ক্ষমা দিতে পারেন, যদিও সাধারণত এমনটি করা হয় না।
আইন বিশ্লেষকদের মতে—
- সিদ্ধান্তটি রাষ্ট্রপতির বিবেচনার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করবে
- এটি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি পদক্ষেপ
- এমন সিদ্ধান্ত ইসরাইলের বিচারপদ্ধতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে
কেন এখনই ক্ষমা চাইছেন নেতানিয়াহু? বিশ্লেষকদের মত
বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করেছেন—
১. সম্ভাব্য নেতিবাচক রায়
বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘ হলেও শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তাই নেতানিয়াহু হয়তো আশঙ্কা করছেন রায় তার বিপক্ষে যেতে পারে।
২. রাজনৈতিক টিকে থাকার লড়াই
দুর্নীতির মামলায় দোষী হলে তিনি—
- পদে থাকতে পারবেন না
- রাজনৈতিক ক্যারিয়ার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে
- দলীয় নেতৃত্বও হারাতে পারেন
৩. যুদ্ধ ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি
ইসরাইল বর্তমানে বিভিন্ন নিরাপত্তা সংকটে জর্জরিত।
নেতানিয়াহু চাইছেন তিনি “সংকটকালীন নেতা” হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে সময় ও শক্তি ব্যয় করতে পারেন।
৪. জনসমর্থন পুনরুদ্ধারের চেষ্টা
ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে তিনি জনমতের প্রতি সহানুভূতিতে আঘাত করার চেষ্টা করছেন বলেও মত প্রকাশ করেছেন অনেকে।
ইসরাইলে প্রতিক্রিয়া: বিভক্ত জনমত
ক্ষমা আবেদন প্রকাশের পর ইসরাইলি সমাজ ও রাজনীতিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে—
অনেকেই বলছেন—
- বিচার চলাকালীন সময়ে ক্ষমা চাওয়া আদালতের প্রতি অসম্মান
- এটি রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার উদ্দেশ্য
- আইনের সমতার নীতি লঙ্ঘিত হতে পারে
আবার সমর্থকরাও বলছেন—
- জাতীয় সংকটে নেতানিয়াহুর অভিজ্ঞতা জরুরি
- নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে তার নেতৃত্ব প্রয়োজন
- ক্ষমা দিলে দেশ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মত
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও ঘটনাটিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন। তারা বলছেন—
- ইসরাইলে নেতানিয়াহুর ক্ষমতা ধরে রাখার লড়াই নতুন মাত্রা পেয়েছে
- বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতার ওপর প্রশ্ন উঠতে পারে
- মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্যে এর প্রভাব পড়তে পারে
দুর্নীতির মামলা এখন কোন পর্যায়ে?
বিচার এখনো শেষ হয়নি।
সাক্ষ্য–প্রমাণ গ্রহণের পর বিচারকরা রায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে।
রায় ঘোষণার সম্ভাব্য সময়—
- ২০২৬ সালের প্রথম ছয় মাসের মধ্যেই হতে পারে
- আদালত চাইলে আরও সময় নিতে পারে
নেতানিয়াহুর আইনজীবীরা অবশ্য অভিযোগগুলো সরাসরি অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন—
“মামলাগুলো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
এখন কী হতে পারে? সম্ভাব্য তিনটি দৃশ্যপট
১. রাষ্ট্রপতি ক্ষমা দিতে পারেন
যদি রাষ্ট্রপতি হারজগ ক্ষমা মঞ্জুর করেন—
- নেতানিয়াহু তাৎক্ষণিকভাবে মামলা থেকে মুক্ত হবেন
- রাজনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন
- বিরোধীদের প্রচণ্ড প্রতিবাদের সম্ভাবনা রয়েছে
২. রাষ্ট্রপতি সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখতে পারেন
এক্ষেত্রে—
- বিচার চলবে
- রায়ের পর নতুন সিদ্ধান্ত আসতে পারে
৩. রাষ্ট্রপতি আবেদন প্রত্যাখ্যান করতে পারেন
যদি তা ঘটে—
- নেতানিয়াহুর জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে যাবে
- রায় তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে
বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমা আবেদন ইসরাইলি রাজনীতিতে এক নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। বিচার প্রক্রিয়ার মাঝপথে এভাবে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করা ইসরাইলের ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল।
রাষ্ট্রপতি হারজগের সিদ্ধান্ত এখন শুধু ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, বরং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনেও গুরুত্ব বহন করে।
নেতানিয়াহু ক্ষমা পাবেন কিনা—এটি শুধু আইনি প্রশ্ন নয়; বরং ইসরাইলের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক গতিপথও অনেকাংশে নির্ভর করবে এ সিদ্ধান্তের ওপর।
বিশ্বজুড়ে নজর এখন রাষ্ট্রপতি হারজগের দিকে—তিনি কী সিদ্ধান্ত নেন, এবং সেই সিদ্ধান্ত ইসরাইলের বিচারব্যবস্থা, রাজনীতি ও জাতীয় স্থিতিশীলতাকে কোন পথে নিয়ে যায়।
MAH – 14073 I Signalbd.com



