খেলা

ইতিহাস গড়লো বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ বালক কাবাডি দল

Advertisement

বাহরাইনে বাংলাদেশের কাবাডি গৌরব

বাহরাইনের রাজধানী মানামার ঈসা স্পোর্টস সিটি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত তৃতীয় এশিয়ান যুব গেমসে এক অনন্য ইতিহাস রচনা করল বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ বালক কাবাডি দল
প্রথমবারের মতো এই গেমসে অংশ নিয়ে তারা ব্রোঞ্জ পদক জয় করে দেশের জন্য গৌরব বয়ে এনেছে।

এর আগে, একই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ বালিকা কাবাডি দল শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ব্রোঞ্জ পদক জিতে ইতিহাস গড়েছিল। ফলে এই দুটি পদক মিলে এবারের এশিয়ান যুব গেমসে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত মোট দুটি ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেছে—যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সাফল্য।

বিশাল ব্যবধানে জিতলো বালক দল

শেষ ম্যাচে বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় স্বাগতিক বাহরাইনের। শুরু থেকেই দুর্দান্ত খেলে লাল-সবুজের যোদ্ধারা ১০৬-১৭ পয়েন্টে বিশাল ব্যবধানে জয় ছিনিয়ে নেয়।
এই জয়ের মধ্য দিয়ে তারা ৭ দলের মধ্যে তৃতীয় স্থান নিশ্চিত করে ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করে।

ম্যাচ চলাকালীন স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিলেন বাহরাইনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ রইস হাসান সরোয়ার। তিনি মাঠেই তরুণ খেলোয়াড়দের অভিনন্দন জানান এবং বলেন—

“এই ছেলেরা আমাদের গর্ব। সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়েও তারা যে লড়াই করেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই সাফল্য বাংলাদেশের কাবাডির জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।”

কঠিন শুরু, দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তন

বাংলাদেশের জন্য টুর্নামেন্টের শুরুটা সহজ ছিল না। প্রথম ম্যাচেই তারা মুখোমুখি হয় শক্তিশালী ভারতের। ম্যাচটি ছিল সম্পূর্ণ একপেশে; অভিজ্ঞ ভারতের কাছে পরাজয়ের পর দলটির মনোবল কিছুটা কমে যায়।

কিন্তু ঠিক পরের ম্যাচেই ঘটে নাটকীয় প্রত্যাবর্তন।
দ্বিতীয় ম্যাচে ইরানকে হারিয়ে বাংলাদেশ দেখিয়ে দেয়—তারা শুধু অংশগ্রহণ করতেই আসেনি, জিততেও এসেছে। এরপর শ্রীলঙ্কাকে পরাজিত করে টানা দ্বিতীয় জয় তুলে নেয় দলটি।

তবে দুর্ভাগ্যবশত থাইল্যান্ডের বিপক্ষে অল্প ব্যবধানে হেরে যায় তারা। সেই হারের কারণেই ফাইনালে ওঠা সম্ভব হয়নি।
তবুও শেষ দুই ম্যাচে পাকিস্তান ও বাহরাইনকে হারিয়ে তারা ব্রোঞ্জ পদক নিশ্চিত করে টুর্নামেন্ট শেষ করে সম্মানের সঙ্গে।

বাংলাদেশ কাবাডির ইতিহাসে এই অর্জনের মানে কী?

বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আন্তর্জাতিক পরিসরে এই খেলায় আমাদের অর্জন খুব বেশি নয়।
এশিয়ান গেমস, সাউথ এশিয়ান গেমস বা অনূর্ধ্ব পর্যায়ের টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ বহুবার অংশ নিয়েও খুব বেশি পদক জিততে পারেনি।

তবে ২০২৫ সালের এই এশিয়ান যুব গেমসের ব্রোঞ্জ পদক সেই চিত্র বদলে দিয়েছে।
এটি শুধু একটি পদক নয়, বরং বাংলাদেশের তরুণ কাবাডি খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।

ক্রীড়া বিশ্লেষকরা বলছেন,

“যেভাবে বাংলাদেশের ছেলেরা খেলেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে দেশে কাবাডির প্রতিভার ঘাটতি নেই। সঠিক প্রশিক্ষণ ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা পেলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ বড় কোনো শিরোপা জিততে পারবে।”

মেয়েদের সাফল্যের পর ছেলেদের জয়

এর আগে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ বালিকা কাবাডি দলও একই টুর্নামেন্টে দারুণ পারফরম্যান্স দেখিয়েছে।
তারা শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ পদক জিতে দেশের জন্য প্রথম পদকটি অর্জন করে।
মেয়েদের সেই ঐতিহাসিক সাফল্যের পর ছেলেদের জয় যেন বাংলাদেশের কাবাডি আন্দোলনে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে।

বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান বলেন—

“আমরা দীর্ঘদিন ধরে যুব পর্যায়ে কাবাডি উন্নয়নের চেষ্টা করছি। এই সাফল্য প্রমাণ করেছে, বিনিয়োগ ও সঠিক প্রশিক্ষণ দিলে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে এশিয়ান কাবাডিতে বড় শক্তি হয়ে উঠতে পারে।”

প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি: সফলতার পেছনের গল্প

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ বালক দলের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ প্রস্তুতি ও কঠোর পরিশ্রম।
দলটি গত তিন মাস ধরে নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে ইনডোর ক্যাম্পে অনুশীলন করেছে।
তাদের সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় কোচ সঞ্জয় দাস, যিনি কাবাডি খেলার আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষক হিসেবে পরিচিত।

কোচ সঞ্জয় বলেন—

“বাংলাদেশের এই তরুণ খেলোয়াড়রা অত্যন্ত উদ্যমী। তাদের মধ্যে খেলার প্রতি ভালোবাসা ও দেশের জন্য কিছু করার তীব্র ইচ্ছা আছে। এই মনোভাবই তাদের এগিয়ে নিয়ে গেছে।”

কাবাডির এশিয়ান গেমসের ইতিহাসে বাংলাদেশের অবস্থান

কাবাডি প্রথমবার এশিয়ান গেমসে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৯০ সালে।
তখন থেকে ভারত এই খেলায় আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। ইরান, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়া পরবর্তী শক্তিশালী দলগুলোর মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশ মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় ভালো খেলে থাকে, বিশেষ করে সাউথ এশিয়ান গেমসে
কিন্তু এশিয়ান গেমস বা যুব গেমসে আগে কখনো তারা পদক জিততে পারেনি।
তাই ২০২৫ সালের এই ব্রোঞ্জ পদক বাংলাদেশের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশ কাবাডি ফেডারেশন এখন এই অর্জনকে পুঁজি করে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করছে।
২০২৬ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এশিয়ান জুনিয়র কাবাডি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
এছাড়া তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য জেলা পর্যায়ে কাবাডি একাডেমি ও ট্যালেন্ট হান্ট প্রোগ্রাম চালু করার পরিকল্পনাও রয়েছে।

বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সাইফুল বারি টিপু বলেন—

“এই সাফল্য আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। এখন সময় এসেছে কাবাডিকে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার। তরুণদের আগ্রহই আমাদের শক্তি।”

মাঠে আনন্দ, দেশে উদযাপন

ম্যাচ শেষে খেলোয়াড়দের চোখে-মুখে ছিল আনন্দ ও গর্বের ছাপ।
দলনেতা মোহাম্মদ রাসেল ইসলাম বলেন—

“আমরা দেশের পতাকা উঁচু করতে চেয়েছিলাম। আজ সেটি করতে পেরেছি—এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত।”

বাংলাদেশে খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই সামাজিক মাধ্যমে ভরে যায় অভিনন্দন বার্তায়।
ক্রীড়া প্রেমীরা লিখছেন, “এটাই বাংলাদেশ! এটাই আমাদের কাবাডি!”

বাহরাইনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় এশিয়ান যুব গেমসে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৮ বালক কাবাডি দলের এই সাফল্য শুধু একটি পদক নয়—এটি দেশের ক্রীড়া সম্ভাবনার প্রতীক।
যেভাবে তারা দুর্ভাগ্য পেরিয়ে জয়ের হাসি ছিনিয়ে এনেছে, তা ভবিষ্যতের প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের কাবাডির এই উত্থান যদি অব্যাহত থাকে, তবে একদিন হয়তো লাল-সবুজ পতাকা উড়বে এশিয়ার শীর্ষে—স্বর্ণের মঞ্চে।

MAH – 13455 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button