খার্তুমে সেনাবাহিনীর অগ্রগতি: গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এলাকা পুনর্দখলে সেনাবাহিনী

সুদানের খার্তুমে সেনাবাহিনী কর্তৃক কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অঞ্চলের দখল পুনরুদ্ধার নিয়ে সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেনাবাহিনীর দাবি, তারা খার্তুম নর্থ অঞ্চলের প্রায় পুরো নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করেছে এবং রাজধানী খার্তুমের দখল পুনরুদ্ধারের জন্য তারা আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। দেশটির সেনাবাহিনীর মুখপাত্র নাবিল আবদুল্লাহ এক বিবৃতিতে জানান, খার্তুম নর্থের গুরুত্বপূর্ণ জেলা কাফুরি পুনর্দখল করা হয়েছে এবং ওই অঞ্চলের অনেক আরএসএফ সদস্যকে শহরতলির বাহরিতে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
খার্তুম নর্থের দখল পুনরুদ্ধারে সেনাবাহিনীর সফলতা
সেনাবাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত শুক্রবার সেনাবাহিনী এবং তাদের মিত্ররা “দাগলো সন্ত্রাসী মিলিশিয়ার অবশিষ্ট অংশ”কে কাফুরি জেলা থেকে বিতাড়িত করেছে। খার্তুম নর্থের এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে আরএসএফের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল। এই অঞ্চলে আরএসএফ কমান্ডার মোহাম্মদ হামদান দাগলোর ভাই ও উপপ্রধান আবদেল রহিম দাগলোরও বেশ কিছু সম্পত্তি রয়েছে। সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তাদের অভিযানে আরএসএফ বাহিনীর বিরোধিতা অস্বাভাবিক মাত্রায় শক্তিশালী ছিল, তবে সেনাবাহিনীর অগ্রগতির কারণে পরিস্থিতি বদলেছে। এর সাথে সাথে, সেনাবাহিনী পূর্ব দিকে ১৫ কিলোমিটার দূরের শারক এল নিল অঞ্চলের অন্যান্য এলাকায়ও দখল পুনরুদ্ধার করেছে।
এই অগ্রগতি সেনাবাহিনীর অন্যতম বড় অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ যুদ্ধের শুরুতে আরএসএফ খার্তুম এবং অন্যান্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকার অধিকাংশ অংশ দখল করেছিল। সেনাবাহিনীর কাছে খবর রয়েছে যে, তারা বর্তমানে রাজধানীর কেন্দ্রে আক্রমণ করছে, যা শহরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুনর্দখলে সহায়ক হবে।
সংঘর্ষ এবং বিস্ফোরণ: যুদ্ধের উত্তপ্ত পরিস্থিতি
পাশাপাশি, খার্তুমে চলমান সংঘর্ষের মধ্যে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। স্থানীয়রা জানায় যে, শহরের দক্ষিণে ব্যাপক বিস্ফোরণ ঘটে এবং সেখানে গুলি বিনিময় চলছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া আরএসএফ এবং সেনাবাহিনীর সংঘর্ষে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। এই অঞ্চলে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়ানোর সাথে সাথে, খার্তুমসহ বেশ কিছু শহর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এতে নাগরিকদের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, সেনাবাহিনীর দখল পুনরুদ্ধারের খবরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মানবাধিকার সংস্থাটি সতর্ক করেছে যে, সেনাবাহিনীর দখলে আসা নতুন এলাকায় প্রতিশোধমূলক হামলা হতে পারে এবং সেখানে আরএসএফ সমর্থকদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কা রয়েছে।
আরএসএফের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
আরএসএফের বিরুদ্ধে জাতিগত সহিংসতার অভিযোগও রয়েছে, যাকে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ‘গণহত্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সমানভাবে জাতিগত সহিংসতা পরিচালনার অভিযোগ উঠেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই পরিস্থিতির অবসানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেছে। তাদের দাবি, এই সহিংসতা শুধুমাত্র সামরিক বাহিনী এবং আরএসএফের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং নিরীহ বেসামরিক জনগণের উপরও এর প্রভাব পড়ছে।
দারফুরে সেনাবাহিনীর বিমান হামলা
দারফুরে আরএসএফের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর বিমান হামলা অব্যাহত রয়েছে। এই হামলার ফলে দারফুরের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে এবং সেখানে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। গত সপ্তাহে দারফুর রাজ্যের রাজধানী নাইয়ালায় সেনাবাহিনীর বিমান হামলায় ৫৭ জন নিহত হয়েছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সেনাবাহিনী এবং আরএসএফের মধ্যে সংঘর্ষের কারণে দারফুর অঞ্চলে মানবিক সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে।
দারফুরে সংঘর্ষের ফলে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। বহু মানুষ গৃহহীন হয়েছে এবং তারা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে দ্রুত মানবিক সহায়তা প্রেরণের দাবি উঠেছে।
আন্তর্জাতিক মানবিক সংকট
এই সংঘাত সুদানকে ব্যাপক মানবিক সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সারা দেশে ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যুদ্ধবিরতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সুদানে কার্যকরী হস্তক্ষেপ দাবি করছে।
বিশ্বের অন্যতম বড় এই মানবিক সংকট মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। মানবিক সাহায্য প্রেরণের জন্য নানা আন্তর্জাতিক তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তবে স্থলযুদ্ধ এবং আকাশযুদ্ধের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
উপসংহার
সুদানে চলমান এই সংঘাত একটি নতুন মাত্রায় প্রবেশ করেছে এবং এর ফলে খার্তুমসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে। সেনাবাহিনীর কিছু এলাকা পুনরুদ্ধার করা হলেও, আরএসএফের সাথে সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং দ্রুত শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সকল পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
এই সংকটের সমাধান কিভাবে হবে তা এখনও অনিশ্চিত, তবে সুদানের জনগণের জন্য এটি একটি কালো অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের জন্য শান্তি এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার তাগিদ এখন বেশি জরুরি।