
বিশ্ব ফুটবলের বর্ণিল আসর ক্লাব বিশ্বকাপ। বিশ্বসেরা ক্লাবগুলোর পারস্পরিক লড়াইয়ের মঞ্চ হিসেবে এটি বরাবরই নজর কাড়ে ফুটবলপ্রেমীদের। কিন্তু এই আয়োজনে থাকা একাধিক বিতর্ক এবং সমালোচনার মাঝে এবার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিলেন ব্রাজিলিয়ান উইঙ্গার রাফিনিয়া। বার্সেলোনার এই তারকা খেলোয়াড় অভিযোগ করেছেন, ক্লাব বিশ্বকাপে ফুটবলারদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে খেলানো হচ্ছে, যা খেলোয়াড়দের অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।
ছুটি কেড়ে নিচ্ছে ক্লাব বিশ্বকাপ
রাফিনিয়া সম্প্রতি ব্রাজিলের সাও পাওলোতে এক অনুষ্ঠানে দেশটির খ্যাতনামা গণমাধ্যম ‘গ্লোবো’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই অভিযোগ করেন। তাঁর বক্তব্য, মৌসুম শেষ হওয়ার পর জুন-জুলাই মাসে খেলোয়াড়রা সাধারণত ছুটিতে যান—এ সময়টা তাদের বিশ্রাম ও পরবর্তী মৌসুমের জন্য শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতির। কিন্তু এখন ক্লাব বিশ্বকাপের কারণে সেই ছুটি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, এবং খেলোয়াড়দের বাধ্যতামূলকভাবে খেলানো হচ্ছে, যা অমানবিক ও অনৈতিক।
রাফিনিয়া বলেন, “কেউ যদি ইউরোপীয় কোনো ক্লাবের হয়ে খেলে, তাহলে এই সময়ে তার ছুটিতে থাকার কথা। উদাহরণস্বরূপ, পিএসজির মারকিনিওস এবং লুকাস বেরালদো চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলেছে, এরপর তারা জাতীয় দলে খেলেছে এবং এখন ক্লাব বিশ্বকাপে খেলছে। তাদের কোনো বিরতির সুযোগ নেই। এভাবে একের পর এক ম্যাচ খেলে যাওয়া শুধু ক্লান্তিকর নয়, এটা খেলোয়াড়দের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল।”
তিনি আরও যোগ করেন, “অনেকে ভাবতে পারে এটা কোনো বাহানা, কিন্তু আসলে ছুটি বাতিল করতে বাধ্য হওয়া অনেক বড় একটি মানসিক ও শারীরিক চাপ। আমরা যেহেতু পেশাদার, আমাদের ওপর একটা নিরব চাপ সবসময় থাকে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ক্লাবগুলো আমাদের ছুটি কেড়ে নিতে পারবে।”
বার্সার অনুপস্থিতি ও দর্শকদের আক্ষেপ
ক্লাব বিশ্বকাপে বার্সেলোনার অনুপস্থিতি নিয়ে সমর্থকদের মধ্যে আগে থেকেই আক্ষেপ ছিল। গত মৌসুমে ক্লাবটির হতাশাজনক পারফরম্যান্সের কারণে তারা এই প্রতিযোগিতায় খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ফলে দর্শকরা বঞ্চিত হয়েছে লামিনে ইয়ামাল, রাফিনিয়া, কিংবা লেভানডফস্কির মতো তারকাদের খেলোয়াড় দেখতে পাওয়ার সুযোগ থেকে।
রাফিনিয়ার বক্তব্য সেই আক্ষেপকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। তিনি যেনো দর্শকদের আরও একবার বুঝিয়ে দিলেন—ক্লাব বিশ্বকাপের আড়ালে লুকিয়ে আছে খেলোয়াড়দের আত্মত্যাগ ও কষ্টের অজানা অধ্যায়।
ব্রাজিলিয়ান ক্লাবগুলোর প্রশংসা
তবে ক্লাব বিশ্বকাপ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মাঝেও রাফিনিয়া ব্রাজিলিয়ান ক্লাবগুলোর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের প্রশংসা করতে ভুলেননি। এবারের আসরে ফ্ল্যামেঙ্গো, পালমেইরাস, ফ্লুমিনেন্স ও বোতাফোগোর মতো চারটি ব্রাজিলিয়ান ক্লাব গ্রুপ পর্ব অতিক্রম করে উঠেছে শেষ ষোলোতে, যা রীতিমতো চমক হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
রাফিনিয়া বলেন, “ব্রাজিলিয়ান ক্লাবগুলোর অনেক সম্ভাবনা আছে এবং তারা অত্যন্ত মানসম্পন্ন খেলছে। তারা কঠিন ম্যাচগুলোয় জয় অথবা ড্র করে এই পর্যায়ে এসেছে। এটা প্রমাণ করে যে তারা ঠিক পথে এগোচ্ছে এবং নিজেদের যোগ্যতায় এই টুর্নামেন্টে ভালো করছে। আমি তাদের জন্য গর্বিত।”
ক্লাব বনাম খেলোয়াড়: এক পুরনো দ্বন্দ্ব
রাফিনিয়ার বক্তব্য নতুন কিছু নয়, বরং এটি ক্লাব ফুটবলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি পুরনো দ্বন্দ্বেরই পুনরাবৃত্তি—ক্লাবের চাহিদা ও খেলোয়াড়ের স্বার্থ। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বছরে কয়েকটি উইন্ডো থাকলেও, ক্লাব ফুটবলের ক্যালেন্ডার এখন এতটাই ঠাসা যে খেলোয়াড়দের বিশ্রামের সময় প্রায় নেই বললেই চলে।
ফিফা ও অন্যান্য সংগঠন মাঝে মধ্যেই ক্লাব বিশ্বকাপের সময়সূচি নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে। কিন্তু বাণিজ্যিক চাপে ও সম্প্রচার অধিকার থেকে আসা বিপুল অর্থের কারণে এই টুর্নামেন্টগুলো এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। অথচ খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্য, ক্লান্তি এবং মানসিক চাপ—এসব প্রশ্ন বারবার উপেক্ষিত থেকে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাফিনিয়ার মতো একজন সুপ্রতিষ্ঠিত খেলোয়াড়ের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য আসা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এটি ফুটবল প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ে একটি আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি করতে পারে।
খেলোয়াড়দের পাশে সাবেকরা
রাফিনিয়ার বক্তব্যের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছেন অনেক সাবেক ফুটবলার ও ক্রীড়া বিশ্লেষকরাও। তাদের মতে, আজকের পেশাদার ফুটবল বিশ্বে ক্লাবগুলো খেলোয়াড়দের শুধু ‘সম্পদ’ হিসেবে দেখে, যেখানে খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত জীবন, বিশ্রাম ও পরিবারকে গৌণ বলে মনে করা হয়।
সাবেক ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় গিলবার্তো সিলভা এক টিভি আলোচনায় বলেন, “একজন খেলোয়াড়ের শারীরিক সক্ষমতা যতই থাকুক না কেন, মানসিক চাপ এবং ক্লান্তি একসময় তার কর্মক্ষমতাকে নিচে নামিয়ে আনে। ক্লাব বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট যদি খেলোয়াড়দের ওপর চাপ বাড়ায়, তবে তাতে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিই বেশি হবে।”
ক্লাব বিশ্বকাপ ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন
রাফিনিয়ার এই বক্তব্য ক্লাব বিশ্বকাপ নিয়ে ভবিষ্যতে আরও আলোচনার জন্ম দেবে তা বলাই বাহুল্য। ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর এখন প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির—যেখানে খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনায় রেখে প্রতিযোগিতার সূচি নির্ধারণ করা হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্লাব বিশ্বকাপের বর্তমান ফরম্যাট ও সময়সূচি পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। খেলোয়াড়দের মৌসুমি বিশ্রাম বাধ্যতামূলক করার মতো নীতিমালা তৈরি করা গেলে এটি শুধু খেলোয়াড়দের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে ফুটবলের মান রক্ষায়ও সহায়ক হবে।
উপসংহার
রাফিনিয়ার বক্তব্য ফুটবল দুনিয়ায় এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তিনি কেবল নিজের নয়, বরং হাজারো ফুটবলারের আবেগ ও ক্লান্তির কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন। ক্লাব ফুটবলের রাজনীতির জটিল এই দুনিয়ায় খেলোয়াড়দের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা সহজ নয়, কিন্তু সময় এসেছে খেলোয়াড়দের মানবিক দিকটি গুরুত্ব দিয়ে দেখার। ক্লাব বিশ্বকাপ হয়তো চলবে, চ্যাম্পিয়নও হবে কেউ, কিন্তু সেই জয়ে যারা নিজেদের পরিবার, স্বাস্থ্য ও মানসিক প্রশান্তি হারায়—তাদের কথাও কি মনে রাখবে বিশ্ব ফুটবল?