
সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসরের সঙ্গে আরও দুই বছরের জন্য চুক্তি নবায়ন করলেন পর্তুগিজ মহাতারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। নতুন চুক্তি অনুযায়ী ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত আল নাসরের হয়ে মাঠ মাতাবেন পাঁচবারের ব্যালন ডি’অরজয়ী এই ফুটবলার। বুধবার এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে আল নাসর ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
রোনালদোর এই চুক্তি নবায়ন সৌদি ফুটবলের জন্য যেমন বড় এক অর্জন, তেমনি বিশ্ব ফুটবলে তাঁর অবস্থান ও প্রভাবের বিষয়েও নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই জল্পনা চলছিল, চলতি মৌসুম শেষেই হয়তো বিদায় নেবেন রোনালদো। বিশেষ করে আল নাসরের হয়ে কোনো বড় শিরোপা জিততে না পারায় অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, ৪০ বছর বয়সী এই ফুটবলার সৌদি অধ্যায় শেষ করে নতুন পথ বেছে নেবেন।
তবে সেই জল্পনায় জল ঢেলে দিয়েছে ক্লাবটির নতুন ঘোষণাটি।
সমুদ্রসৈকতে হাঁটা, টিজার ভিডিওতে ঘোষণা
বুধবার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে একটি টিজার ভিডিও প্রকাশ করে আল নাসর। সেখানে সমুদ্রসৈকতে হেঁটে যাচ্ছেন রোনালদো। ব্যাকগ্রাউন্ডে আবেগঘন সংগীত, আর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘আল নাসর ফরএভার’। মাত্র কয়েক মিনিট পরেই আসে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা—ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো আরও দুই বছর থাকছেন আল নাসরে।
চুক্তি নবায়নের সময় ক্লাব চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আলমাজেদের সঙ্গে ছবি পোস্ট করেন রোনালদো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে লেখা, “এই ক্লাবের হয়ে খেলা আমার জন্য গর্বের। আমি বিশ্বাস করি, আমরা একসঙ্গে আরও ইতিহাস লিখব।”
আল নাসরে যাত্রা ও প্রভাব
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সৌদি প্রো লিগের ক্লাব আল নাসরের সঙ্গে চুক্তি করেন রোনালদো। ওই সময় তাঁর ইউরোপ ছাড়ার সিদ্ধান্ত বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। তবে রোনালদোর এই পদক্ষেপই পরবর্তীতে সৌদি লিগে একের পর এক তারকা ফুটবলারের আগমনের পথ তৈরি করে।
রোনালদোর পথ ধরে সৌদি লিগে নাম লেখান করিম বেনজেমা, নেইমার, সাদিও মানে, রবার্তো ফিরমিনোর মতো বিশ্বসেরা তারকারা। তাঁদের অনেকেই নিজেদের ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসেছেন ঠিকই, তবে সৌদি লিগকে বিশ্বমঞ্চে প্রতিষ্ঠিত করতে তাঁদের অবদান অস্বীকার করা যায় না।
পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (পিআইএফ)—যারা সৌদি লিগের বড় বিনিয়োগকারী—এর এক কর্মকর্তার ভাষায়, “রোনালদো আমাদের সবচেয়ে বড় দূত। তিনি শুধু একজন খেলোয়াড় নন, সৌদি ফুটবলের রূপান্তরের প্রতীক।”
শিরোপাহীন আড়াই মৌসুম, তবুও আস্থা অবিচল
আল নাসরে যোগ দেওয়ার পর আড়াই মৌসুম কেটে গেলেও এখন পর্যন্ত রোনালদো কোনো লিগ বা মহাদেশীয় শিরোপা জিততে পারেননি। ক্লাবটির হয়ে ১১১টি ম্যাচ খেলে ৯৯টি গোল করেছেন তিনি। এমন পারফরম্যান্স যে কোনো খেলোয়াড়ের জন্য গর্বের হলেও রোনালদোর মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী একজন তারকার কাছে তা হয়তো যথেষ্ট নয়।
২০২৫ সালের মে মাসে সৌদি প্রো লিগের শেষ ম্যাচের কয়েক ঘণ্টা পর রোনালদো লিখেছিলেন, ‘এই অধ্যায় শেষ।’ এরপর থেকেই গুঞ্জন শুরু হয়, তিনি ক্লাব ছাড়ছেন। ইউরোপ ফেরার সম্ভাবনা নিয়েও কিছু গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। তবে এখন দেখা যাচ্ছে, সে সব গুজবই ছিল ভিত্তিহীন।
আল নাসরের পক্ষ থেকেও তাঁকে ধরে রাখতে সব ধরনের চেষ্টা চালানো হয়। শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টাই সফল হলো।
ক্যারিয়ার শেষ আল নাসরে?
রোনালদো ইতিমধ্যে ৪০ বছরে পা রেখেছেন। বয়সের ভারে শারীরিক সক্ষমতা কিছুটা কমলেও মাঠে তাঁর প্রভাব এখনও অটুট। প্রতিপক্ষের ডিফেন্স ভেদ করে গোল করার দক্ষতা, ফ্রি-কিক বা হেডে গোল করার নিখুঁততা এখনও রয়ে গেছে।
গত বছর এক সাক্ষাৎকারে রোনালদো বলেছিলেন, “আমি হয়তো আমার ক্যারিয়ার শেষ করব আল নাসরেই।” এবারের চুক্তি নবায়নের মধ্য দিয়ে সেটি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেল।
চুক্তি অনুযায়ী ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত তিনি আল নাসরের সঙ্গে থাকবেন। তখন তাঁর বয়স হবে ৪২ বছর। এমন বয়সে পেশাদার ফুটবলে খেলা যে বিরল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে এটিই হতে যাচ্ছে তাঁর ফুটবল ক্যারিয়ারের শেষ ধাপ।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনায় রোনালদো
ফুটবল ছাড়ার পর কী করবেন রোনালদো? এ নিয়ে ভক্তদের কৌতূহলের শেষ নেই। অনেকে ভাবছেন, তিনি কোচিংয়ে আসবেন। কেউবা বলছেন, তিনি সৌদি ফুটবলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হবেন।
বর্তমানে তিনি নিজেই একটি স্বাস্থ্য, ফিটনেস ও পোশাক ব্র্যান্ড পরিচালনা করছেন। ফুটবল-পরবর্তী জীবনেও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকার ইচ্ছা তাঁর রয়েছে বলেই জানান তিনি।
তবে এর আগ পর্যন্ত মাঠেই মনোযোগ দিতে চান। নতুন চুক্তির পর তিনি বলেন, “আমার লক্ষ্য এখন শুধু একটি—আল নাসরের হয়ে শিরোপা জেতা। আমার ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার আগে আমি এই ক্লাবের ট্রফি ক্যাবিনেটে আরও কিছু সাফল্য যোগ করতে চাই।”
শেষ কথা
ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মতো একজন খেলোয়াড়ের দীর্ঘ সময় ধরে একটি ক্লাবে থাকা কেবল ফুটবলীয় সাফল্যের জন্য নয়, ক্লাব সংস্কৃতি, ফ্যানবেস ও পুরো ফুটবল ব্যবস্থার জন্যও তা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। সৌদি আরব এবং আল নাসর এমন একটি সুযোগ পেয়েছে, যা বিশ্ব ফুটবলের ইতিহাসে বিরল।
রোনালদোর আল নাসরে থাকা শুধু একটি চুক্তি নয়, এটি সৌদি ফুটবলের এক স্বপ্নযাত্রা, যার প্রতিটি মুহূর্ত ইতিহাস হয়ে উঠবে।