
ক্রিকেটের মাঠে তাঁর বিচক্ষণতা ও গভীর জ্ঞানের জন্য ভক্তরা তাঁকে ‘বিজ্ঞানী’ বলে ডাকেন। তবে এবার সেই ‘বিজ্ঞানী’ রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বিরুদ্ধে উঠেছে গুরুতর অভিযোগ। তামিলনাড়ু প্রিমিয়ার লিগে (টিএনপিএল) দিন্দিগুল ড্রাগনসের হয়ে খেলা এই সাবেক ভারতীয় স্পিনার এবং তাঁর দলের বিরুদ্ধে বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ এনেছে মাদুরাই প্যান্থার্স। অভিযোগে বলা হয়েছে, রাসায়নিক তরলে ভেজানো তোয়ালে ব্যবহার করে বলের গঠন পরিবর্তন করা হয়েছে, যা ক্রিকেটের নিয়মের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ঘটনায় টিএনপিএল কর্তৃপক্ষ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে এবং মাদুরাই প্যান্থার্সকে তথ্য-প্রমাণ জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
গত শনিবার টিএনপিএলের একটি ম্যাচে মাদুরাই প্যান্থার্সের বিপক্ষে ৯ উইকেটের জয় পায় দিন্দিগুল ড্রাগনস। এই ম্যাচে অশ্বিন ৪ ওভারে ২৭ রান দিয়ে কোনো উইকেট নিতে পারেননি। তবে তাঁর ব্যাটিং ছিল উল্লেখযোগ্য। ওপেনার হিসেবে ২৯ বলে ৪৯ রান করে দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। কিন্তু ম্যাচ শেষে উত্তেজনা ছড়ায় বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ ঘিরে।
মাদুরাই প্যান্থার্সের অভিযোগ, দিন্দিগুল ড্রাগনস ম্যাচে রাসায়নিক পদার্থে ভেজানো তোয়ালে ব্যবহার করে বল মুছেছে। এর ফলে বল অপেক্ষাকৃত ভারী হয়ে গেছে এবং ব্যাটের সংস্পর্শে ধাতব শব্দ উৎপন্ন হয়েছে। ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা এস মহেশ টিএনপিএলকে পাঠানো একটি চিঠিতে বলেন, “দিন্দিগুল ড্রাগনসের বিপক্ষে আমাদের সাম্প্রতিক ম্যাচে বল টেম্পারিংয়ের মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে। আম্পায়ারদের একাধিকবার সতর্ক করা সত্ত্বেও দিন্দিগুল দল রাসায়নিক মাখানো তোয়ালে ব্যবহার করেছে।”
টিএনপিএলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রসন্ন কানন এ বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে বলেছেন, “মাদুরাই প্যান্থার্স অভিযোগ দায়ের করেছে, যা আমরা গ্রহণ করেছি। তবে নিয়ম অনুযায়ী, ম্যাচ শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযোগ দাখিল করতে হয়। তারপরও আমরা বিষয়টি আমলে নিয়ে তাদের তথ্য-প্রমাণ জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি।” তিনি আরো যোগ করেন, “যদি অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়, আমরা একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করব। তবে পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়া কোনো খেলোয়াড় বা ফ্র্যাঞ্চাইজির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করা ঠিক নয়। প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হলে মাদুরাইকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।”
ম্যাচের প্রেক্ষাপট এবং বৰ্ষার প্রভাব
বর্ষা মৌসুমে টিএনপিএল আয়োজনের কারণে ম্যাচে বৃষ্টির প্রভাব পড়ছে। গত শনিবারের ম্যাচটিও বৃষ্টির কারণে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে শুরু হয়। মাদুরাই প্যান্থার্স প্রথমে ব্যাট করে ৮ উইকেটে ১৫০ রান সংগ্রহ করে। জবাবে দিন্দিগুল ড্রাগনস ১২.৩ ওভারে মাত্র ১ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্য তাড়া করে। তবে ম্যাচের ফলাফল এখন বল টেম্পারিং বিতর্কে ছায়াচ্ছন্ন।
টিএনপিএলের নিয়ম ও তদারকি
টিএনপিএল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভেজা মাঠের কন্ডিশন বিবেষে প্রতিটি ফ্র্যাঞ্চাইজি দলকে তামিলনাড় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (টিএনসিএ) সরবরাহ করা তোয়ালে ব্যবহার করতে হয়। খেলোয়াড়রা শুধু আম্পায়ারের উপস্থিতিতে এই তোয়ালে দিয়ে বল শুকনো করতে পারেন। প্রসন্ন কানন বলেন, “টিএনপিএলের দেওয়া তোয়ালে ছাড়া অন্য কোনো তোয়ালে ব্যবহার করা যায় না। প্রতি ছক্কার পর বা আউটের পর আম্পায়াররা বল পরীক্ষা করেন। ওই ম্যাচে আম্পায়াররা কোনো সমস্যা খুঁজে পাননি।”
অশ্বিনের ক্রিকেট ক্যারিয়ার ও বিতর্ক
রবিচন্দ্রন অশ্বিন ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সফল স্পিনার। টেস্ট ক্রিকেটে তিনি ৫০০টির বেশি উইকেট নিয়েছেন এবং তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ের জন্য বিশ্বে প্রশংসিত। তবে তাঁর ক্যারিয়ারে বিতর্কও কম হয়নি। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির মাঝপথে অবসর ঘোষণা করে তিনি আলোচনায় আসেন। এর আগে আইপিএল ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বিভিন্ন কারণে তাঁর সমালোচনা হয়েছে।
বল টেম্পারিংয়ের এই অভিযোগ অশ্বিনের খ্যাতির উপর ছায়া ফেলেছে। তবে এটি প্রমাণিত না হওয় পর্যন্ত তিনি নির্দোষ বলেই বিবেচিত হবেন। টিএনপিএলের তদন্ত কমিটি এই অভিযোগের সত্যতা যাচাই করবে এবং প্রমাণের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
ক্রিকেটে বল টেম্পারিংয়ের ইতিহাস
বল টেম্পারিং ক্রিকেটে একটি স্পর্শকাতর বিষয়। অতীতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই খেলার সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। ২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার ক্যামেরন ব্যাঙ্ক্রফট স্যান্ডপেপার ব্যবহার করে বল টেম্পারিংয়ের চেষ্টা করেছিলেন, যা ‘স্যান্ডপেপারগেট’ নামে পরিচিত। এ ঘটনায় অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ ও সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নারের উপর এক বছরের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এছাড়া, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্যান্য দলের খেলোয়াড়দেরও এমন অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
বল টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে বলের একটি পাশে ক্ষয়টনা করা হয়, যার ফলে বোলাররা অতিরিক্ত সুইং বা স্পিন পেতে পারেন। এটি ক্রিকেটের নিয়মের পরিপন্থী এবং খেলোয়াড় ও দলের জন্য গুরুতর শাস্তি বয়ে আনতে পারে।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
এই অভিযোগের পর সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। এক্স প্ল্যাটফর্মে অনেকে অশ্বিনের পক্ষে কথা বললেও কেউ কেউ তাঁর সমালোচনা করেছেন। এক্সে একটি পোস্টে বলা হয়েছে, “অশ্বিনের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ বিশ্বাস করা কঠিন। তবে প্রমাণ ছাড়া কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা ঠিক নয়।” [
উপসংহার
রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও দিন্দিগুল ড্রাগনসের বিরুদ্ধে বল টেম্পারিংয়ের অভিযোগ ক্রিকেট বিশ্বে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। টিএনপিএল কর্তৃপক্ষের তদন্তের ফলাফল এই ঘটনার পরিণতি নির্ধারণ করবে। প্রমাণের অভাবে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হতে পারে, অথবা সত্যতা প্রমাণিত হলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে দিন্দিগুলকে। এই ঘটনা ক্রিকেটে নৈতিকতা ও খেলার মান নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।