
আন্তর্জাতিক ফুটবলে নতুন প্রত্যাবর্তনের দিনে ঘরের মাঠেই উজ্জ্বল পারফরম্যান্স দেখালো বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফিফা আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে ভুটানকে ২-০ গোলে পরাজিত করেছে হাভিয়ের ক্যাবরেরার দল। একদিকে আন্তর্জাতিক ম্যাচ ফিরলো ঐতিহাসিক এই ভেন্যুতে, অন্যদিকে লাল-সবুজের প্রতিনিধিরা তুলে নিলো জয়। দেশের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য একরকম দ্বিগুণ উৎসবই বলা চলে।
বাংলাদেশের হয়ে গোল করেন ইংল্যান্ড প্রিমিয়ার লিগ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মিডফিল্ডার হামজা চৌধুরী এবং অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার সোহেল রানা। হামজার এটি ছিল জাতীয় দলের জার্সিতে অভিষেক ম্যাচ, আর সেই অভিষেকেই গোলের দেখা পেয়ে নিজেকে জানান দিলেন স্টাইলেই।
ম্যাচের শুরুতে তীব্র আগ্রাসন
প্রথম থেকেই ম্যাচে আধিপত্য দেখিয়েছে স্বাগতিক বাংলাদেশ। ম্যাচের প্রথম ১৫ মিনিটেই তিনটি আক্রমণ চালিয়ে ভুটানের রক্ষণভাগকে চাপে রাখে তারা। মিডফিল্ডে জামাল ভূঁইয়া ও হামজা চৌধুরীর নিয়ন্ত্রণে খেলার গতি ছিল ছন্দময়। ডান প্রান্তে বিপলু ও বাম দিকে রবিউল হাসান আগ্রাসী খেলেছেন, যা বারবার ভুটানের রক্ষণে ভীতি ছড়িয়েছে।
ম্যাচের ২২তম মিনিটে আসে প্রথম গোল। কর্নার থেকে বল পেয়ে ডি-বক্সের বাইরে থেকে চমৎকার এক ডান পায়ের ভলিতে বল জালে জড়ান হামজা চৌধুরী। গোলের পর স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকদের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। এটি ছিল দেশের জার্সিতে তার প্রথম গোল এবং একইসঙ্গে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর এক বার্তা।
দ্বিতীয়ার্ধে সোহেলের জয়সূচক গোল
প্রথমার্ধে ১-০ গোলে এগিয়ে থেকে মাঠ ছাড়ে বাংলাদেশ। বিরতির পর কিছুটা গুছিয়ে খেলতে থাকে ভুটান, তবে বাংলাদেশের রক্ষণভাগ ছিল সুশৃঙ্খল। ইয়াসিন আরাফাত ও তপু বর্মন ছিলেন জমাট রক্ষণে, যার ফলে ভুটান বিশেষ কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারেনি।
ম্যাচের ৬৫তম মিনিটে দ্বিতীয় গোলটি আসে সোহেল রানার পা থেকে। মিডফিল্ড থেকে দুর্দান্ত পাসে বল পেয়ে দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে গোলরক্ষকের বাঁ দিক দিয়ে বল জালে পাঠান অভিজ্ঞ এই খেলোয়াড়। এই গোলে নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের জয়।
ঘরের মাঠে ফিরে ঐতিহাসিক উপলক্ষ
২০১৯ সালের পর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে এটি ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ। দীর্ঘদিন সংস্কার কাজ ও নানা কারণে মাঠটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যবহার করা হয়নি। এই প্রত্যাবর্তনের দিনে জয় পাওয়াটা শুধু তিন পয়েন্ট নয়, বরং আত্মবিশ্বাস পুনর্গঠনের একটি দিকও বটে।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন বলেন, “এই জয় আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘরের মাঠে ফিরেই জয় পাওয়া দলের আত্মবিশ্বাস বাড়াবে। একইসাথে দর্শকদের ভালো খেলার আশাও জাগাবে।”
হামজার অভিষেক উদযাপন
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইংলিশ ফুটবলার হামজা চৌধুরী প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামলেন। অভিষেক ম্যাচেই দারুণ পারফরম্যান্স দেখিয়ে প্রমাণ করলেন তিনি কতটা কার্যকরী হতে পারেন। ইংল্যান্ডের লেস্টার সিটির সাবেক এই মিডফিল্ডার বল দখলে, পাসিং ও প্লেসমেন্টে ছিলেন দুর্দান্ত। তার আগমনে মিডফিল্ডে নতুন একটি গতি ও কৌশল এসেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সিঙ্গাপুর ম্যাচের আগে আত্মবিশ্বাস বাড়ল
এই ম্যাচ ছিল বাংলাদেশের আসন্ন সিঙ্গাপুর সফরের আগে প্রস্তুতির অংশ। ১০ জুন সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে আরেকটি প্রীতি ম্যাচ খেলবে বাংলাদেশ। ভুটানের বিপক্ষে জয় সেই ম্যাচের আগে দলের আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন কোচ হাভিয়ের ক্যাবরেরা।
ম্যাচ শেষে ক্যাবরেরা বলেন, “দল ভালো খেলেছে। বিশেষ করে নতুন খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্স চোখে পড়ার মতো। এখন আমাদের লক্ষ্য হবে সিঙ্গাপুর ম্যাচেও একই ছন্দে খেলা।”
দর্শকদের প্রত্যাবর্তনও উল্লেখযোগ্য
দীর্ঘ বিরতির পর জাতীয় স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ম্যাচ ফিরেছে, সঙ্গে ফিরেছে দর্শকের গর্জনও। প্রায় ২৫ হাজার দর্শক উপস্থিত ছিলেন ম্যাচ দেখতে, যা প্রমাণ করে দেশের মানুষ এখনও আন্তর্জাতিক ফুটবলের জন্য কতটা আগ্রহী। গ্যালারিতে জাতীয় পতাকা, ফেস্টুন ও ড্রাম বাজিয়ে দর্শকেরা অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন দলকে।
উপসংহার
বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য এই জয় শুধু একটি ম্যাচ জয় নয়, বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজেদের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। নবাগতদের পারফরম্যান্স, অভিজ্ঞদের নেতৃত্ব এবং ঘরের মাঠে দর্শকদের সমর্থনে এটি ছিল এক আদর্শ রাত। এখন লক্ষ্য থাকবে সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা এবং আগামীর কঠিন ম্যাচগুলোতেও ভালো কিছু উপহার দেওয়া।