খেলাক্রিকেট

এবার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বললেন ক্লাসেন

মে-জুন মাস যেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজগতের জন্য এক বিদায়ের ধারা বয়ে এনেছে। গত মাসে ভারতের দুই কিংবদন্তি রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন। এরপর জুনের শুরুতেই অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল বিদায় নেন ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলেন দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম নির্ভরযোগ্য উইকেটরক্ষক-ব্যাটার হেনরিখ ক্লাসেন, যিনি শুধু একটি নয়— আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সব ফরম্যাট থেকেই সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।

৩৩ বছর বয়সী এই প্রোটিয়া ক্রিকেটার আজ সোমবার (২ জুন) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে একটি আবেগঘন বার্তায় নিজের অবসরের খবর জানান। ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে এক দুঃখজনক সংবাদ। ক্লাসেন ছিলেন একজন প্রতিভাবান ব্যাটার, যে উইকেটের পেছনে যেমন নিখুঁত ছিলেন, তেমনি ব্যাট হাতে দলের প্রয়োজনে অসংখ্যবার গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস উপহার দিয়েছেন।

ইনস্টাগ্রাম বার্তায় আবেগঘন বিদায়

ক্লাসেন তার ইনস্টাগ্রাম বার্তায় লেখেন, “আমার জন্য আজকের দিনটা দুঃখভারাক্রান্ত। অনেক চিন্তা-ভাবনার পর আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই সিদ্ধান্তটা সহজ ছিল না। তবে আমি মনে করি, এখনই সময় আমার নিজের ও পরিবারের দিকে মনোযোগ দেওয়ার।”

তিনি আরও বলেন, “ক্রিকেটের জন্য আমি সবকিছু উজাড় করে দিয়েছি। তবে এখন আমি এমন একটি অধ্যায়ে প্রবেশ করতে চাই, যেখানে পরিবারকে আরও বেশি সময় দিতে পারব। আশা করি, এই নতুন যাত্রায় আমি শান্তি ও তৃপ্তি খুঁজে পাব।”

তার এই বিদায়ী বার্তায় ছিল কৃতজ্ঞতার ছোঁয়া। ক্লাসেন তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে পাশে থাকা সকল কোচ, সতীর্থ, পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং সমর্থকদের ধন্যবাদ জানান। উল্লেখ করেন, “আমার ওপর যাদের বিশ্বাস ছিল, যাঁরা আমাকে এই পথ চলায় অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন, তাদের কাছে আমি চিরঋণী।”

চার ফরম্যাটেই ক্লাসেনের অবদান

হেনরিখ ক্লাসেনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার যদিও তুলনামূলকভাবে ছোট, তবে তার পরিসংখ্যান প্রমাণ করে তিনি একজন কার্যকর খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ১২২টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ৬০টি ওয়ানডে, ৪০টি টি-টোয়েন্টি এবং ৪টি টেস্ট ম্যাচ।

ওয়ানডে পরিসংখ্যান:

ওয়ানডে ক্রিকেটে ক্লাসেন খেলেছেন ৬০টি ম্যাচ, যেখানে তিনি ৪৩.৬৯ গড়ে সংগ্রহ করেছেন ২১৪১ রান। এই ফরম্যাটে তার সর্বোচ্চ রান ছিল ১৭৪। একজন মিডল অর্ডার ব্যাটার হিসেবে এই গড় অত্যন্ত প্রশংসনীয়, বিশেষ করে বর্তমান যুগে যেখানে স্ট্রাইক রেট এবং দ্রুত রান করাই হয়ে উঠেছে মাপকাঠি।

টি-টোয়েন্টি পরিসংখ্যান:

টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তিনি অংশ নিয়েছেন ৪০টি ম্যাচে। সেখানে তিনি ১৪১.৮৪ স্ট্রাইক রেটে করেছেন মোট ১০০০ রান। তার সর্বোচ্চ স্কোর ছিল ৮১। এই ফরম্যাটে ক্লাসেন ছিলেন একজন আগ্রাসী ব্যাটার, যিনি ম্যাচের গতিপথ বদলে দিতে পারতেন কেবল কয়েকটি বলেই।

টেস্ট ক্রিকেটে সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ার:

টেস্ট ক্রিকেটে ক্লাসেনের ক্যারিয়ার সংক্ষিপ্ত হলেও তা উপেক্ষণীয় নয়। তিনি মাত্র চারটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তিনি সাদা পোশাকের ক্রিকেট থেকে অবসর নেন। যদিও টেস্টে তিনি খুব বেশি সুযোগ পাননি, তবে তার টেকনিক ও ব্যাটিংয়ের ধৈর্য তাকে ভালো একটি সম্ভাবনাময় খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত করে তোলে।

ঘরোয়া ও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবসর নিলেও ক্লাসেন এখনই ক্রিকেটকে পুরোপুরি বিদায় বলছেন না। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি ঘরোয়া ক্রিকেট এবং বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি লিগে (বিশেষ করে আইপিএল, এসএ২০, বিগ ব্যাশ লিগ) খেলা চালিয়ে যাবেন। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে তার ব্যাটিং ক্ষমতা এবং দ্রুত রান তোলার দক্ষতা তাকে এখনও জনপ্রিয় একটি নাম হিসেবে গড়ে তুলেছে।

বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন প্রজন্মের ক্রিকেটারদের জন্য তিনি এক অনুপ্রেরণা। কঠোর পরিশ্রম, সততা ও ধৈর্যের মাধ্যমে তিনি নিজেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরেছিলেন।

ক্লাসেনের অবসরের প্রেক্ষাপট

এই বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একাধিক তারকা ক্রিকেটার অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। কোহলি-রোহিতের টেস্ট অবসর, ম্যাক্সওয়েলের ওয়ানডে থেকে বিদায়— এসবের মাঝে ক্লাসেনের পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিদায় আরও এক আবেগঘন অধ্যায় হিসেবে ধরা দিলো।

অনেক ক্রিকেট বিশ্লেষক মনে করছেন, বর্তমান ক্রিকেট কাঠামো, অবিরাম খেলার চাপ, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ভারসাম্যের অভাব— সব মিলিয়ে খেলোয়াড়েরা এখন আগেভাগেই অবসর নিচ্ছেন। ক্লাসেনও হয়তো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও সম্ভাবনা

হেনরিখ ক্লাসেন এখন যদি কোচিং, মেন্টরশিপ কিংবা ধারাভাষ্য পেশায় যুক্ত হন, তাও অবাক করার মতো কিছু হবে না। ক্রিকেট মাঠে তার অভিজ্ঞতা এবং দৃঢ় মানসিকতা ভবিষ্যতে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের জন্য বড় সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড এক বিবৃতিতে ক্লাসেনের অবদানের প্রশংসা করে জানায়, “তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সি গায়ে সর্বদা সম্মান এনেছেন। তার ব্যাটিং ছিল নির্ভরযোগ্য এবং কিপিং ছিল নিখুঁত। আমরা তার ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা জানাই।”

শেষ কথা

হেনরিখ ক্লাসেন এমন এক ক্রিকেটার, যিনি কখনও আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন না, কিন্তু দলের প্রয়োজনের সময় নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠতেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার এই বিদায় হয়তো হঠাৎ মনে হতে পারে, তবে এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনা এবং আত্মত্যাগ। এমন একজন খেলোয়াড়ের বিদায় ক্রিকেট দুনিয়ায় নিঃসন্দেহে এক শূন্যতা তৈরি করবে।

তবে ভক্তরা এখনো আশাবাদী যে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে আবারো তার সেই চেনা আগ্রাসী ব্যাটিং দেখার সুযোগ পাবেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বললেও, ক্লাসেনের ক্রিকেটযাত্রা এখানেই শেষ নয়— বরং নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা মাত্র।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button