আঞ্চলিক

গণতন্ত্র পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে : খালেদা জিয়া

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, দেশে গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন পদযাত্রা পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। তিনি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪৪তম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ মন্তব্য করেন। রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বৃহস্পতিবার (২৯ মে ২০২৫) অনুষ্ঠিত এই সভায় তাঁর ধারণকৃত বক্তব্য প্রচার করা হয়। খালেদা জিয়া গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে চলার জন্য দলের নেতা-কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।

গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকার

খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে বলেন, “যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াইয়ে জিয়াউর রহমান শাহাদাতবরণ করেছেন, সে গণতন্ত্রের নিরবচ্ছিন্ন পদযাত্রা আজ পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।” তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “খুব শিগগির বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেখতে পাবেন।” তিনি জোর দিয়ে বলেন, “শহীদ জিয়ার শাহাদাতবার্ষিকীতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হোক আমাদের অঙ্গীকার।” তিনি বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান এবং দেশবাসীকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের পথে সামিল হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করেন।

তিনি আরও বলেন, “মনে রাখবেন, সবার জন্য গণতন্ত্র ও উন্নয়নের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধানের যে রাজনীতি শহীদ জিয়া রেখে গেছেন, তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। আমরা তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।” খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় এবং গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থা প্রকাশ পায়, যা দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে।

আলোচনা সভার বিবরণ

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খালেদা জিয়া। তবে তাঁর স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারলেও তাঁর ধারণকৃত বক্তব্য ভিডিওর মাধ্যমে প্রচার করা হয়। সভায় ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে প্রধান আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এছাড়া, সভায় সভাপতিত্ব করেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, সালাহউদ্দিন আহমদ, ইকবাল হাসান মাহমুদ এবং হাফিজ উদ্দিন আহমদ। এছাড়া, রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহও তাঁর মূল্যবান মতামত পেশ করেন। সভাটি সঞ্চালনা করেন বিএনপি নেতা সুলতান সালাউদ্দিন।

জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী ও গণতন্ত্রের লড়াই

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে শহীদ হন বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। তাঁর শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতিবছর বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। এবারের আলোচনা সভায় জিয়াউর রহমানের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই এবং তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে জিয়াউর রহমানের গণতান্ত্রিক আদর্শ এবং জনকল্যাণমুখী রাজনীতির কথা উল্লেখ করেন।

জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে দলটি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। তাঁর শাসনামলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও জাতীয় সংহতির জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে এই অবদানের কথা স্মরণ করে বলেন, “জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন ছিল সবার জন্য গণতন্ত্র ও উন্নয়ন। তাঁর এই আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা তাঁর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানাতে পারি।”

গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ ও বিএনপির ভূমিকা

খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্রমাগতভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, এবং জনগণের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন যে, বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার মাধ্যমে বিএনপির নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হয়েছে। তিনি নিজেও ২০১৮ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় কারাবন্দী ছিলেন, যদিও ২০২৫ সালের ১৫ জানুয়ারি তিনি বেকসুর খালাস পান। আপিল বিভাগ এই মামলাকে “প্রতিহিংসামূলক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে উল্লেখ করে।

বিএনপির নেতারা এই সভায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তারেক রহমান তাঁর ভার্চুয়াল বক্তব্যে বলেন, “আমাদের লড়াই শুধু ক্ষমতার জন্য নয়, জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য।” তিনি দলের নেতা-কর্মীদের সংগঠিত হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা

খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি প্রভাবশালী নাম। তিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী। ১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর তিনি গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৮৪ সাল থেকে বিএনপির চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তাঁর রাজনৈতিক জীবনে তিনি বহু চড়াই-উতরাই পার করেছেন। ২০০৭ ও ২০১৮ সালে তিনি কারাবন্দী হন এবং স্বাস্থ্যগত কারণে ২০২৫ সালে লন্ডনে চিকিৎসা নেন। তিনি সবসময় গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকারের জন্য সোচ্চার ছিলেন, যা তাঁর বক্তব্যে বারবার প্রকাশ পেয়েছে।

গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে

বিএনপির নেতারা এই সভায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তারা অভিযোগ করেন যে, বিগত বছরগুলোতে নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ছিল না। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “আমাদের লড়াই একটি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। আমরা জনগণের পাশে থাকব।”

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ তাঁর বক্তব্যে বলেন, “গণতন্ত্র শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বরং জনগণের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়।” তিনি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরেন এবং বিএনপির ভূমিকার ওপর আলোকপাত করেন।

সমাপনী

খালেদা জিয়ার বক্তব্য এবং এই আলোচনা সভা বিএনপির গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নতুন গতি সঞ্চার করেছে। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠান শুধু তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যম নয়, বরং গণতন্ত্র ও জনকল্যাণের প্রতি বিএনপির অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করার একটি মঞ্চ হিসেবে কাজ করেছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button