আঞ্চলিক

অস্ত্রের মুখে ট্রাকসহ ১৭ গরু নিয়ে গেল ডাকাতরা

পাবনার ঈশ্বরদীতে ভয়াবহ এক ডাকাতির ঘটনায় সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে ট্রাকসহ ১৭টি গরু লুট করে নিয়ে গেছে। এ সময় তারা ট্রাকচালকসহ তিনজনকে অপহরণ করে রাজশাহীর চারঘাটে সড়কের পাশে ফেলে রেখে যায়। ঘটনা বুধবার ভোররাতে ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি এলাকার দাশুড়িয়া-নাটোর-রাজশাহী আঞ্চলিক মহাসড়কে ঘটে।

ঘটনাটি এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে এবং গরু ব্যবসায়ী ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঈদুল আজহা ঘনিয়ে আসায় কোরবানির পশু পরিবহন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে এমন একটি সংগঠিত ডাকাতির ঘটনা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর বড় ধরনের প্রশ্ন তুলেছে।

কী ঘটেছিল সেই রাতে?

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার দিবাগত রাত আনুমানিক ২টার দিকে দিনাজপুর থেকে আসা একটি ট্রাকে ১৭টি গরু বোঝাই করে ঈশ্বরদী হয়ে অন্যত্র যাচ্ছিলেন গরু ব্যবসায়ীরা। যখন ট্রাকটি ঈশ্বরদীর মুলাডুলি শেখপাড়া এলাকায় পৌঁছায়, তখন হঠাৎ করে আরেকটি ট্রাক সামনে এসে পথরোধ করে।

ট্রাকটি থামার সঙ্গে সঙ্গে সাত থেকে আটজন অস্ত্রধারী ডাকাত সামনে এসে অস্ত্রের মুখে ট্রাকচালক, হেলপার এবং গরু দেখভাল করা একজনকে জিম্মি করে ফেলে। এরপর তাদের হাত-পা ও মুখ বেঁধে অন্য একটি ট্রাকে তুলে নেয়া হয়। গরু বোঝাই ট্রাকটি নিয়ে ডাকাতদল দ্রুত পালিয়ে যায়।

অপহরণ ও ফেলে যাওয়া

ঈশ্বরদী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শরিফুজ্জামান জানান, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ সক্রিয় হয়ে ওঠে। লালনশাহ সেতুর সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ডাকাতদের একটি ট্রাক গরু নিয়ে সেতু পার হয়ে ভেড়ামারার দিকে চলে যায়, আরেকটি ট্রাক সেতু অতিক্রম না করে অন্যদিকে ঘুরে যায়।

পরে জানা যায়, দ্বিতীয় ট্রাকটিতেই জিম্মি অবস্থায় থাকা তিনজন ছিলেন। ডাকাত দল তাদের নিয়ে গিয়ে রাজশাহীর চারঘাট এলাকায় সড়কের পাশে ফেলে রেখে চলে যায়। সকালবেলা তারা ঈশ্বরদী থানায় এসে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেন।

উদ্ধার অভিযান ও তদন্ত

পুলিশ জানায়, ডাকাতির কয়েক ঘণ্টা পর মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তারা জানতে পারেন, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি ট্রাক পড়ে আছে। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ট্রাকটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। তবে ট্রাকের ভেতরে কোনো গরু ছিল না।

ঈশ্বরদী থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম বলেন, “ঘটনাটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। ট্রাক উদ্ধার করা গেলেও গরুগুলো এখনো উদ্ধার হয়নি। আমরা সিসিটিভি ফুটেজ, মোবাইল ট্র্যাকিং এবং গোপন সূত্রের ভিত্তিতে তদন্ত চালাচ্ছি। এ ঘটনায় মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং ডাকাত গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযান চলছে।”

ঈদ সামনে রেখে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ

ডাকাতির এই ঘটনার পর ঈশ্বরদী ও আশেপাশের এলাকায় গরু ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জেলা থেকে গরু রাজধানী ও বড় শহরগুলোর কোরবানির হাটে আনা হচ্ছে। এই সময়ে এমন একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতে আরও বড় অপরাধ সংঘটনের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।

স্থানীয় গরু ব্যবসায়ী আবদুল মতিন বলেন, “ঈদের সময় এমনিতেই আমরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করি। এতগুলো গরু এক ট্রাকে নেওয়া মানে লাখ লাখ টাকার মালামাল। আর এখন যদি নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানো না যায়, তাহলে তো ব্যবসা করাই মুশকিল হয়ে যাবে।”

প্রশাসনের ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীলরা বলছেন, গরু পরিবহনের সময় রুট ও সময় আগে থেকে পুলিশকে জানালে বিশেষ নজরদারির আওতায় রাখা সম্ভব। তবে দেশের বিভিন্ন সড়কে রাতের বেলা নিরাপত্তার ঘাটতি এবং মহাসড়কের কিছু জায়গায় আলোকস্বল্পতা ডাকাতদের জন্য সুযোগ তৈরি করছে।

এদিকে, পাবনার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শাহিনুর রহমান বলেছেন, “গরু লুটের ঘটনায় ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু হয়েছে। ডাকাতদলের সদস্যদের চিহ্নিত করে দ্রুত তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঈদের আগে বিশেষ টহল জোরদার করা হবে।”

অতীতেও ঘটেছে এমন ঘটনা

ঈশ্বরদী অঞ্চলে এর আগেও মহাসড়কে গরুবোঝাই ট্রাক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে কোরবানির ঈদের সময় এসব ঘটনা বেড়ে যায়। ২০২২ সালে ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়া এলাকায় একই ধরনের ঘটনায় ১২টি গরু লুট হয়েছিল। পুলিশ তখনও তদন্ত করে কয়েকজনকে আটক করেছিল, কিন্তু সম্পূর্ণ গরু উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

করণীয় ও সুপারিশ

বিশেষজ্ঞদের মতে, গরু পরিবহনের সময় মহাসড়কে নিরাপত্তা বাড়ানো, সন্দেহভাজন যানবাহনের গতিবিধির উপর নজরদারি এবং সিসিটিভি ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি। ব্যবসায়ীদেরও সচেতন থাকতে হবে এবং প্রয়োজনে স্থানীয় থানার সঙ্গে সমন্বয় করে চলাচল করতে হবে।

সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, “এই ধরনের সংঘবদ্ধ ডাকাতি রোধে একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার থাকা প্রয়োজন, যেখানে প্রতিটি গরু পরিবহন ট্রিপের তথ্য সংরক্ষিত থাকবে এবং পুলিশ সেই তথ্যের মাধ্যমে তৎপর থাকতে পারবে।”

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button