৪ বিভাগে অতি ভারী বৃষ্টির আভাস, ভূমিধসের শঙ্কা

আগামী বুধবার (২৮ মে) সকাল ১০টা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় দেশের চারটি বিভাগে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণের সতর্কতা জারি করেছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর। এই সময়ে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং কক্সবাজার জেলার পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের আশঙ্কার কথাও জানানো হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের এই সতর্কবার্তা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং জনসাধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা বহন করছে।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সক্রিয় সঞ্চালনশীল মেঘমালার প্রভাবে খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম এবং সিলেট বিভাগে ভারী (৪৪-৮৮ মিমি/২৪ ঘণ্টা) থেকে অতি ভারী (>৮৮ মিমি/২৪ ঘণ্টা) বর্ষণ হতে পারে। এই অঞ্চলে স্বাভাবিক বর্ষা মৌসুমেও বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বেশি থাকলেও, এবার অতি ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস বিশেষ উদ্বেগের কারণ। পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের শঙ্কা বিবেচনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সোমবার (২৬ মে) সন্ধ্যায় আবহাওয়াবিদ মো. শাহীনুল ইসলামের সই করা ভারী বৃষ্টিপাতের সতর্কবার্তায় এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতর নিয়মিতভাবে আবহাওয়ার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে এবং সে অনুযায়ী তথ্য প্রদান করছে। এটি জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য অত্যন্ত জরুরি।
ভারী বর্ষণ এবং ভূমিধসের কারণ:
ভারী বর্ষণ এবং ভূমিধসের শঙ্কা মূলত পাহাড়ি অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণে সৃষ্টি হয়। পাহাড়ের মাটি সাধারণত আলগা এবং কম সংহত হয়। যখন একটানা ভারী বৃষ্টিপাত হয়, তখন মাটির কণাগুলোর মধ্যে পানি প্রবেশ করে এবং মাটিকে দুর্বল করে তোলে। এর ফলে মাটি তার নিজস্ব ওজন ধরে রাখতে না পেরে নিচের দিকে ধসে পড়ে। বিশেষ করে, চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি জেলাগুলো যেমন রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান এবং কক্সবাজারে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা এবং বৃক্ষ নিধনের কারণে ভূমিধসের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃক্ষরাজি মাটিকে আঁকড়ে ধরে রাখে এবং ভূমিধস প্রতিরোধে সহায়তা করে। কিন্তু নির্বিচারে বন উজাড় করার কারণে এই প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি এবং করণীয়:
আবহাওয়া অধিদফতরের এই সতর্কবার্তা পাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এবং স্থানীয় জনগণের জন্য কিছু জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
- পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসকারীদের স্থানান্তর: ভূমিধসের ঝুঁকিতে থাকা এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনকে এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখতে হবে।
- দুর্যোগ প্রস্তুতি সভা: জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোকে জরুরি সভা আহ্বান করে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- প্রচারণা ও সচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যম এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে ভূমিধসের ঝুঁকি এবং করণীয় সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সতর্কবার্তা পাঠানো যেতে পারে।
- জরুরি সেবা প্রস্তুত রাখা: উদ্ধারকারী দল, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স এবং মেডিকেল টিমকে প্রস্তুত রাখতে হবে যাতে যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দেওয়া যায়।
- যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ: পাহাড়ি অঞ্চলে ভারী বৃষ্টির সময় রাস্তাঘাট পিচ্ছিল হতে পারে এবং ভূমিধসের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুসারে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
- পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা: শহর ও গ্রামীণ এলাকায় জলাবদ্ধতা এড়াতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা পরীক্ষা ও পরিষ্কার রাখতে হবে।
আর্থ-সামাজিক প্রভাব:
অতি ভারী বর্ষণ এবং ভূমিধসের কারণে কেবল জীবন ও সম্পদের ক্ষতিই হয় না, এর আর্থ-সামাজিক প্রভাবও সুদূরপ্রসারী। কৃষিক্ষেত্রে এর প্রভাব গুরুতর হতে পারে। অতি বৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হতে পারে, যা কৃষকদের জীবিকার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া, সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় পণ্য পরিবহন এবং সরবরাহ শৃঙ্খল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেতে পারে। পর্যটন শিল্পও এর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, বিশেষ করে কক্সবাজার এবং বান্দরবানের মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে পর্যটকদের আগমন কমে যেতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদী সমাধান:
ভূমিধসের ঝুঁকি কমানোর জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
- পাহাড় কাটা বন্ধ করা: অবৈধভাবে পাহাড় কাটা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- বনায়ন কর্মসূচি: পাহাড়ি এলাকায় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। স্থানীয় এবং দ্রুত বর্ধনশীল গাছ লাগিয়ে মাটির ক্ষয় রোধ করা যেতে পারে।
- ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ: ভূমিধসের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করতে এবং সেখানে স্থিতিশীলতা বাড়ানোর জন্য ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ পরিচালনা করতে হবে।
- নিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন: পাহাড়ি এলাকায় নতুন কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করার আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ) করতে হবে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
মঙ্গলবার (২৭ মে) এর আবহাওয়ার পূর্বাভাস:
এদিকে, মঙ্গলবার (২৭ মে) এর জন্য আবহাওয়ার বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বিদ্যুৎ চমকানো/হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি/বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে সারাদেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে। সারাদেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।”
এই পূর্বাভাস ইঙ্গিত দেয় যে, মঙ্গলবার থেকেই সারাদেশজুড়ে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে শুরু করবে, যা বুধবার থেকে আরও তীব্র হতে পারে। তাই এই সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জনসাধারণকে সতর্ক থাকতে হবে এবং আবহাওয়া অধিদফতরের নির্দেশাবলী অনুসরণ করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি।
উপসংহার:
আবহাওয়া অধিদফতরের এই সতর্কবার্তা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। অতি ভারী বর্ষণ এবং ভূমিধসের শঙ্কা মোকাবিলায় সরকার, স্থানীয় প্রশাসন এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সচেতনতা বৃদ্ধি, কার্যকর প্রস্তুতি এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশবান্ধব পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম হব।