ঈদযাত্রায় জিম্মি বাসযাত্রীরা, ১২০ শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া বৃদ্ধি

ঈদুল আজহার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের পরিবহন খাতে নৈরাজ্যের চিত্র ফুটে উঠেছে। ঈদযাত্রাকে কেন্দ্র করে যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। দেশের খ্যাতনামা পরিবহন কোম্পানিগুলো রুটভেদে ভাড়া ১২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে, যা যাত্রীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) দায়িত্বহীনতা এবং তদারকির অভাবে এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
ভাড়া বৃদ্ধির চিত্র
বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির ওয়েবসাইট, অনলাইন টিকিট প্লাটফর্ম ‘বিডি টিকেটস’ এবং কাউন্টার পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ঈদযাত্রার সময় ভাড়া বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক। উদাহরণস্বরূপ, শ্যামলী এন.আর ট্রাভেলসের নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা-রংপুর রুটে এসি বাসের স্বাভাবিক ভাড়া ১,০০০ টাকা। কিন্তু আগামী ৫ জুন এই রুটে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ২,২০০ টাকা, যা ১২০ শতাংশ বৃদ্ধি। একইভাবে, নাবিল পরিবহনের ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে ইকোনমি ক্লাস এসি বাসের ভাড়া স্বাভাবিক সময়ে ১,৩০০ টাকা, কিন্তু ঈদে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২,৩০০ টাকা, অর্থাৎ ৭৭ শতাংশ বৃদ্ধি।
রাজশাহী রুটেও পরিস্থিতি একই। দেশ ট্রাভেলসের কল্যাণপুর-রাজশাহী রুটে বিজনেস ক্লাস এসি বাসের ভাড়া স্বাভাবিক সময়ে ১,১০০ টাকা, কিন্তু ঈদে অতিরিক্ত ৭০০ টাকা বাড়িয়ে ১,৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে, যা ৬৩ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি। হানিফ এন্টারপ্রাইজের ঢাকা-রংপুর রুটে এসি বাসের টিকিট ২৬ মে ১,৫০০ টাকায় বিক্রি হলেও, ৫ জুনের টিকিটের জন্য ২,৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে, যা ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি। শ্যামলী পরিবহনের কল্যাণপুর-রংপুর রুটে এসি বাসের ভাড়া স্বাভাবিক সময়ে ১,২০০ টাকা থেকে ঈদে বেড়ে হয়েছে ২,০০০ টাকা, অর্থাৎ ৬৬.৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি।
নন-এসি বাসের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বিআরটিএর নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী, ঢাকার গাবতলী থেকে মেহেরপুর (পাটুরিয়া ঘাট হয়ে) রুটে নন-এসি বাসের ভাড়া ৬৭৩ টাকা। কিন্তু গোল্ডেন লাইন ও পূর্বাশা পরিবহন এই রুটে ঈদযাত্রায় ৮০০ টাকা আদায় করছে। একইভাবে, ঢাকা-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রুটে বিআরটিএ নির্ধারিত ভাড়া ৮৪০ টাকা হলেও, কেটিসি হানিফের নন-এসি বাসের টিকিট ৫ জুনের জন্য ১,২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নাবিল পরিবহনের ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে নন-এসি বাসের স্বাভাবিক ভাড়া ১,১০০ টাকা, কিন্তু ঈদে অতিরিক্ত ১১০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
পরিবহন কোম্পানির যুক্তি
পরিবহন কোম্পানিগুলো তাদের ভাড়া বৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি দিচ্ছে যে, ঈদের সময় যাত্রীদের গন্তব্য একমুখী হয়। ঢাকা থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রী থাকলেও, ফিরতি পথে বাসগুলো ফাঁকা থাকে, ফলে লোকসান হয়। এই ক্ষতি এড়াতে তারা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। তবে যাত্রীদের অভিযোগ, এই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের পেছনে কোনো সুস্পষ্ট নীতি বা নিয়ন্ত্রণ নেই। পরিবহন মালিক সমিতির গাইডলাইন উল্লেখ করা হলেও, বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না।
হানিফ এন্টারপ্রাইজের মহাব্যবস্থাপক আব্দুস সামাদ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “আমরা সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার চার্ট অনুযায়ী ভাড়া আদায় করছি।” তবে বাস্তব চিত্র তার বিপরীত। শ্যামলী পরিবহনের মালিক রমেশ চন্দ্র ঘোষ ও শ্যামলী এন.আর ট্রাভেলসের মালিক শুভংকর ঘোষ রাকেশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কোনো সাড়া দেননি।
বিআরটিএর ভূমিকা ও দায়িত্বহীনতা
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) নন-এসি বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও, এই নিয়মের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। চলতি মে মাসে সেতুর টোল ও ফেরি সার্ভিসের ফি বৃদ্ধির কারণে আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লার রুটে নতুন ভাড়ার খসড়া তৈরি করেছে বিআরটিএ। কিন্তু এই নির্ধারিত ভাড়ার বাইরে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বেআইনি হলেও, পরিবহন কোম্পানিগুলো তা মানছে না।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, “বিআরটিএর দায়িত্বহীন আচরণের কারণে পরিবহন মালিকরা খেয়ালখুশি ভাড়া আদায়ের সাহস পাচ্ছেন। এটি এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু এটি অন্যায়। কর্তৃপক্ষ এটিকে অন্যায় মনে করছে না।” তিনি আরও বলেন, “মানুষ তখনই নিজের ইচ্ছামতো চলে যখন অভিভাবক প্রতিষ্ঠান ঘুমায়। বিআরটিএ ঘুমাচ্ছে, কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন না।”
সরকারি উদ্যোগ ও বাস্তবতা
গত ১২ মে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের সভাপতিত্বে ঈদযাত্রা নিরাপদ করতে এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে পৃথক ভিজিলেন্স ও মনিটরিং টিম গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এই টিমে বিআরটিএ, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), সিটি করপোরেশন ও মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে কাজ করার কথা। কিন্তু এই উদ্যোগের বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো বক্তব্য দেননি।
যাত্রীদের ক্ষোভ
ঈদযাত্রার সময় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের ফলে যাত্রীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সাধারণ যাত্রী মো. রিপন মিয়া বলেন, “ঈদের সময় বাস মালিকরা আমাদের জিম্মি করে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের এই প্রবণতা অন্যায়। দিন দিন আমরা সবকিছুতেই হেনস্থা হচ্ছি।”
অনেক যাত্রী ট্রেন বা নৌপথ বেছে নিচ্ছেন নিরাপত্তা ও অতিরিক্ত ভাড়ার ভোগান্তি এড়াতে। তবে বাসে যাতায়াতের চাহিদা এখনও সর্বাধিক। বাংলাদেশ রেলওয়ে ঈদযাত্রার জন্য অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু করেছে ১৪ মার্চ থেকে, যা অনলাইনে এবং কাউন্টারে পাওয়া যাচ্ছে। তবে বাসের তুলনায় ট্রেনের আসন সংখ্যা সীমিত, ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে বাসের উপর নির্ভর করছেন।
সমাধানের পথ
পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিআরটিএর কঠোর তদারকি এবং সরকারি নীতিমালার কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং জরিমানার ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। এছাড়া, পরিবহন মালিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যুক্তিসঙ্গত ভাড়া নির্ধারণ এবং ফিরতি ট্রিপের লোকসান কমানোর জন্য সরকারি সহায়তার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।
ঈদযাত্রা দেশের মানুষের জন্য একটি আনন্দের সময়। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রবণতা এই আনন্দকে ম্লান করে দিচ্ছে। সরকার, পরিবহন মালিক এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান জরুরি।