ড. ইউনূস থাকতে না চাইলে জনগণ বিকল্প বেছে নেবে: সালাহউদ্দিন আহমদ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে তীব্র আলোচনা চলছে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের সাম্প্রতিক বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, বিএনপি ড. ইউনূসের পদত্যাগের পক্ষে নয়, তবে তিনি যদি নিজ ইচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান, তাহলে জনগণ বিকল্প বেছে নেবে। এই বক্তব্যের মাধ্যমে বিএনপি তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে এবং দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বিএনপির অবস্থান: পদত্যাগ নয়, নির্বাচনী রোডম্যাপ প্রয়োজন
সালাহউদ্দিন আহমদ বৃহস্পতিবার (২২ মে) যমুনা টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে বললে সরকারের কয়েকটি কর্ণার বিলম্বিত করে সরকারকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। আর এই দায়-দায়িত্বগুলো প্রধান উপদেষ্টার ঘাড়ে এসে যাচ্ছে। আমরা চেয়েছি রোডম্যাপ, উনি নিজে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান। রাষ্ট্র পরিচালনায় আবেগের কোনও বিষয় নেই। আবেগতাড়িত কোনও সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয় নয় এটি। আমরা তো উনার পদত্যাগ চাইনি। তারপরও উনি যদি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন যে, উনার অসুবিধা হচ্ছে, থাকতে চান না, তখন জাতি সেটার বিকল্প চিন্তা করবে। এই পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়।”
এই বক্তব্যে বিএনপির অগ্রাধিকার স্পষ্ট হয়েছে। দলটি মনে করে, দেশের বর্তমান সংকট সমাধানে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা এবং সংস্কার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা জরুরি। সালাহউদ্দিন আরও বলেন, “সংস্কার দেড় দুই মাসের মধ্যে করা সম্ভব। সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন একসঙ্গে চলতে পারে। নির্বাচন আয়োজনে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং উনারা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছেন।”
বিএনপির এই অবস্থানে দুটি বিষয় উঠে এসেছে: প্রথমত, তারা ড. ইউনূসের প্রতি সম্মান প্রকাশ করলেও তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গতি বাড়ানোর প্রতি জোর দিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, তারা মনে করে যে, সরকারের ভেতরে এবং বাইরে কিছু গোষ্ঠী নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে, যা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে।
সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের ঘাটতি
সালাহউদ্দিন আহমদ সরকারের সঙ্গে বিএনপির যোগাযোগের ঘাটতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “বিএনপির মতো রাজনৈতিক দল যদি ৫-৬ দিনেও সাক্ষাৎ না পায়, এটা খুবই দুঃখজনক। তাতেই বোঝা যায়, সম্পর্ক কী রকম যাচ্ছে। আমরা সরকারকে সবসময় সহযোগিতা করেছি, কিন্তু সরকারেরই কোনও মহল বিএনপিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।”
তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, সরকারের ভেতরে কিছু আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী গোষ্ঠী বিএনপিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছে। এই পরিস্থিতি বিএনপি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ককে জটিল করে তুলছে। বিএনপি মনে করে, সরকারের কিছু কর্মকাণ্ড একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের পক্ষে কাজ করছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ক্ষতিকর।
সেনাপ্রধানের অবস্থান: গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন
সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়েও সালাহউদ্দিন আহমদ ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “সেনাপ্রধান তার আইনি এখতিয়ারের মধ্যে থেকে কর্মকর্তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে অ্যাড্রেস করতে পারেন। তিনি বলেছেন যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা উচিত, সে কথা গত জানুয়ারি বা তার আগেও বলেছেন। সেনাবাহিনী তো অনির্দিষ্টকালের জন্য মাঠে থাকতে পারে না। এটা আমাদের জন্য ভালো দিক যে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী যথাসম্ভব গণতন্ত্রে ফিরতে চান।”
বিএনপি মনে করে, সেনাবাহিনীর এই অবস্থান দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য ইতিবাচক। সালাহউদ্দিন আরও বলেন, “উনি (সেনাপ্রধান) সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হওয়ার মতো কোনও কর্মকাণ্ড করতে দেবেন না বলেছেন, সেটা তো ঠিকই আছে। আমরা উনার বক্তব্যকে সমর্থন করি। এই কারণেই করি যে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছে।”
গোষ্ঠীগত স্বার্থ ও নির্বাচন বিলম্বের অভিযোগ
বিএনপির অভিযোগ, সরকারের ভেতরে ও বাইরে কিছু গোষ্ঠী নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “সরকারের ভেতরে ও বাইরে কয়েকটি চক্র আছে, যারা নির্বাচন চায় না। কেউ কেউ চাইলেও অনেক বিলম্বে চায়। আমরা আরও কয়েকদিন দেখবো, প্রধান উপদেষ্টার যদি শুভবুদ্ধি উদয় হয়, তাহলে ভালো। অন্যথায় আমরা আমাদের পন্থা বেছে নেবো।”
বিশেষ করে, নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের পদক্ষেপকে বিএনপি গোষ্ঠীগত স্বার্থের নমুনা হিসেবে দেখছে। দলটি মনে করে, কিছু ব্যক্তি ড. ইউনূসকে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় রাখার জন্য তৎপরতা চালাচ্ছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ক্ষতিকর।
ইশরাকের শপথ ও আন্দোলন
সালাহউদ্দিন আহমদ ইশরাক হোসেনের শপথ এবং তার সমর্থকদের সাম্প্রতিক আন্দোলন নিয়েও মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “উনারা বলছেন যে যমুনা ঘেরাও হচ্ছে, এটা হচ্ছে, ওটা হচ্ছে— সেই সংস্কৃতি তো উনারা সৃষ্টি করেছেন। ইতোপূর্বে এমন কর্মকাণ্ড করতে উনারা অ্যালাউ করেছেন একটি রাজনৈতিক দলকে। সুতরাং যথাসময়ে যা করা দরকার সেটি না করে চাপের মুখে দাবি মেনে নেয়ার যে সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছেন, এজন্য তো এ সরকারই দায়ী।”
এই বক্তব্যে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চাপের মুখে দাবি মেনে নেওয়ার প্রবণতার সমালোচনা করেছে। দলটি মনে করে, এই ধরনের কর্মকাণ্ড দেশে অস্থিতিশীলতা বাড়াচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বিএনপি জানিয়েছে, তারা শিগগিরই যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সঙ্গে তাদের অবস্থান নিয়ে আলোচনা করবে। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা আরও কয়েকদিন দেখবো। প্রধান উপদেষ্টার যদি শুভবুদ্ধি উদয় হয়, তাহলে ভালো। অন্যথায় আমরা আমাদের পন্থা বেছে নেবো।”
এই বক্তব্যের মাধ্যমে বিএনপি ইঙ্গিত দিয়েছে যে, সরকার যদি দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা না করে, তাহলে তারা আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণের দাবি পূরণের জন্য পদক্ষেপ নেবে।
উপসংহার
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক এবং বিএনপির অবস্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতাকে আরও স্পষ্ট করেছে। বিএনপি একদিকে ড. ইউনূসের প্রতি সম্মান প্রকাশ করছে, অন্যদিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গতি বাড়ানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। সালাহউদ্দিন আহমদের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, বিএনপি দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরুদ্ধার এবং দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে। তবে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের ঘাটতি এবং কিছু গোষ্ঠীর নির্বাচন বিলম্বের প্রচেষ্টা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। আগামী দিনগুলোতে বিএনপি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে সম্পর্ক কোন দিকে যাবে, তা দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।