শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, বকেয়া পরিশোধসহ ১০ দফা দাবি

বাংলাদেশের পোশাক খাত দীর্ঘদিন ধরেই দেশের অর্থনীতির প্রাণসঞ্চারক শক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে। কিন্তু এই শিল্পের চালিকাশক্তি, অর্থাৎ শ্রমিকদের অধিকারের প্রশ্নে বারবার দেখা দিয়েছে নানা অনিয়ম ও অবহেলার চিত্র। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির উদ্যোগে আজ শুক্রবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিত হয়েছে এক তাৎপর্যপূর্ণ শ্রমিক সমাবেশ, যেখানে উত্থাপন করা হয় শ্রমিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ১০ দফা দাবি।
সমাবেশের পটভূমি ও লক্ষ্য
‘শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন ও গণ–অভ্যুত্থানের অর্জন রক্ষায় ঐক্য গড়ো’—এই স্লোগানে আয়োজিত সমাবেশটি ছিল শ্রমিক অধিকার পুনর্দাবির একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এই সমাবেশে বক্তারা শ্রমিকদের প্রতি চলমান অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কণ্ঠ মিলিয়ে রাষ্ট্র ও মালিক পক্ষের কাছে জবাবদিহি দাবি করেন।
বক্তৃতায় উঠে আসে প্রতিবাদের ভাষা
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপ্রধান ও শ্রম সংস্কার কমিশনের সদস্য তাসলিমা আখতার। উপস্থিত ছিলেন শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসান আশরাফ, নারী সংহতির সাধারণ সম্পাদক অপরাজিতা দেবসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, “দেশের ৮ কোটিরও বেশি শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত না হলে গণ–অভ্যুত্থানের অর্জন টেকসই হবে না।” তিনি শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক শ্রম আইন বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের আহ্বান জানান।
জোনায়েদ সাকি বলেন, “শ্রমিকের অধিকার বাস্তবায়নের মাধ্যমেই দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব। শুধু মজুরি নয়, শ্রমিকের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে প্রকৃত অর্থে উন্নয়ন সম্ভব নয়।”
১০ দফা দাবি: শ্রমিক অধিকার পুনর্দাবির রূপরেখা
সমাবেশে উত্থাপিত ১০ দফা দাবি ছিল শ্রমিকদের অধিকার, মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দাবিগুলো হলো—
১. শ্রম সংস্কার কমিশনের সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন: শ্রমিকবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আইনি কাঠামোকে শক্তিশালী করা।
২. শ্রমিক ছাঁটাই ও টার্মিনেশন বন্ধ: হঠাৎ করেই শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা বন্ধ করতে হবে এবং টিএনজেড ও স্টাইল ক্রাফটসহ অন্যান্য কারখানার বকেয়া মজুরি অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে।
৩. মজুরি মূল্যায়ন ও রেশনিং ব্যবস্থা: পূর্বে ঘোষিত ১৮ দফার ভিত্তিতে শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত মজুরি নির্ধারণ ও শ্রমিক এলাকায় রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
৪. ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশনে সহজতা: ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শর্ত শিথিল করে সংখ্যা ভিত্তিক পদ্ধতি চালু করতে হবে, যাতে প্রকৃত শ্রমিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়।
৫. সহিংসতা ও নিপীড়নমুক্ত কর্মপরিবেশ: যৌন নিপীড়ন ও অপমানজনক আচরণের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং কর্মক্ষেত্রে শ্রদ্ধাশীল ভাষা ও আচরণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
৬. মাতৃত্বকালীন ছুটি ও নারী শ্রমিকদের অধিকার: সবেতনে ৬ মাস মাতৃত্বকালীন ছুটি, ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা এবং শ্রম আইনে ‘মহিলা’ শব্দের পরিবর্তে ‘নারী’ শব্দ ব্যবহারের দাবি জানানো হয়।
৭. তথ্যপ্রাপ্তি ও সরকারি জবাবদিহি: শ্রম সংক্রান্ত সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও শ্রমিকদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৮. শিক্ষা ও গণমাধ্যমে শ্রমিকের মর্যাদা: পাঠ্যপুস্তক ও মিডিয়ায় শ্রমিকের সংগ্রাম ও অবদান মর্যাদাসম্পন্নভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
৯. গণ–অভ্যুত্থান ও ট্র্যাজেডির বিচার ও ক্ষতিপূরণ: রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনসহ বিভিন্ন ঘটনায় নিহতদের শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি এবং ন্যায্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করতে হবে।
১০. হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও শ্রম আদালত সম্প্রসারণ: শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার, সংগঠনের অধিকারে হামলার প্রতিবাদে চাকরিচ্যুতি বন্ধ এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে।
সমাবেশ শেষে র্যালি
সমাবেশ শেষে জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকা থেকে একটি র্যালি বের করা হয়। এতে অংশ নেয় শতাধিক শ্রমিক, যারা ‘শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চলবে’ স্লোগানে মুখর ছিল।
পরিশেষে
এই সমাবেশ ও ১০ দফা দাবি দেশের শ্রমনীতি ও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উন্নয়নে এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শ্রমিকরা কেবল উৎপাদনের শক্তি নয়, তাঁরা সমাজ ও রাষ্ট্রের রূপান্তরেও মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারেন—এই বার্তাই উঠে এসেছে আজকের এই আয়োজন থেকে। রাষ্ট্র ও মালিকপক্ষ যদি শ্রমিকদের দাবি ও মর্যাদাকে গুরুত্ব না দেয়, তবে ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের পথ সুগম হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।