আঞ্চলিক

শৈলকূপায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে কৃষকের মর্মান্তিক মৃত্যু

ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়নের মহিষাডাঙ্গা গ্রামে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ফজলুর রহমান (৫৫) নামে এক কৃষকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ফজলুর রহমান ওই গ্রামের মৃত জব্বার বিশ্বাসের ছেলে ছিলেন। এই দুর্ঘটনা মঙ্গলবার দুপুরে ঘটে, যখন তিনি কৃষিকাজ শেষে বাড়িতে ফিরে বিশ্রামের জন্য সেচ পাম্প ঘরে প্রবেশ করেছিলেন।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দুপুরের দিকে ফজলুর রহমান মাঠ থেকে ঘাস কেটে বাড়িতে ফিরে আসেন। ক্লান্ত শরীরে তিনি বিশ্রামের জন্য বাড়ির পাশে থাকা সেচ পাম্প ঘরে প্রবেশ করেন। সেখানে দেওয়ালে হেলান দেওয়ার সময় অসাবধানতাবশত বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন। পরিবারের সদস্যরা তাকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে দ্রুত উদ্ধার করে শৈলকূপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

শৈলকূপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. শাহনেওয়াজ হোসেন জানান, দুপুর ২টার দিকে ফজলুর রহমানকে তার স্বজনেরা হাসপাতালে নিয়ে আসেন। প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা যায়, তিনি ইতোমধ্যে মারা গেছেন। তার দেহে কাঁধের নিচে পোড়ার দাগ পাওয়া গেছে, যা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ। ডা. শাহনেওয়াজ আরও জানান, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার কারণে তার হৃদযন্ত্রের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়, যা তার মৃত্যুর প্রধান কারণ।

শৈলকূপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান জানান, এ ঘটনায় কোনো অভিযোগ না থাকায় মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, “এটি একটি দুর্ঘটনা। আমরা প্রাথমিক তদন্ত করেছি এবং কোনো অপরাধমূলক ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।”

ঘটনার পটভূমি ও প্রভাব

এই ঘটনা শৈলকূপা উপজেলার মহিষাডাঙ্গা গ্রামে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ফজলুর রহমান ছিলেন একজন পরিশ্রমী কৃষক, যিনি তার পরিবারের জন্য কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার অকাল মৃত্যুতে পরিবারটি এখন গভীর শোকের মধ্যে রয়েছে। তার স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ পরিবারের সদস্যরা এই ক্ষতি মেনে নিতে পারছেন না।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল হাকিম বলেন, “ফজলুর ভাই একজন সৎ ও পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। তার এভাবে চলে যাওয়া আমাদের সবাইকে মর্মাহত করেছে। আমরা সবাই তার পরিবারের পাশে আছি।” গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দারাও এই ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বিদ্যুৎ সংযোগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট দুর্ঘটনা: একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা

বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ক্রমশ বাড়ছে। বিশেষ করে কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত সেচ পাম্প, বিদ্যুৎ লাইন এবং অপরিকল্পিত বৈদ্যুতিক স্থাপনার কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ ধরনের ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে শতাধিক মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। এর মধ্যে বেশিরভাগ ঘটনাই ঘটে গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগের মান এবং রক্ষণাবেক্ষণ প্রায়ই অপ্রতুল। ফজলুর রহমানের মৃত্যুর ঘটনাও এই সমস্যার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

স্থানীয় একজন বিদ্যুৎ প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “অনেক সময় গ্রামীণ এলাকায় সেচ পাম্প বা অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। এছাড়া, অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তিরা এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করেন, যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়।” তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ লাইনের নিয়মিত পরিদর্শন এবং সঠিক ইনস্টলেশন নিশ্চিত করা গেলে এ ধরনের দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমানো সম্ভব।

সমাধানের পথ

বিদ্যুৎস্পৃষ্ট দুর্ঘটনা রোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগের নিরাপত্তা মান বৃদ্ধি করতে হবে। সেচ পাম্প এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের নিয়মিত পরিদর্শন এবং রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা চালানো উচিত।

বিশেষজ্ঞরা আরও পরামর্শ দেন যে, সেচ পাম্পের মতো সরঞ্জামে আর্থিং সিস্টেম সঠিকভাবে স্থাপন করা এবং বৈদ্যুতিক তারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। এছাড়া, গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা গেলে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।

স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা

শৈলকূপা উপজেলা প্রশাসন এই ঘটনার পর স্থানীয় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার নিরাপত্তা পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, “আমরা এই ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। আমরা বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে কথা বলে এলাকার সেচ পাম্প এবং বিদ্যুৎ লাইনের নিরাপত্তা পরীক্ষা করব।”

এছাড়া, স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেছেন, সরকারের উচিত গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নে আরও বিনিয়োগ করা। তারা বলছেন, সঠিক পরিকল্পনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এ ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটছে।

পরিবারের শোক ও সমাজের প্রতিক্রিয়া

ফজলুর রহমানের মৃত্যুতে তার পরিবার এখন গভীর শোকের মধ্যে রয়েছে। তার স্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, “আমার স্বামী আমাদের সব ছিলেন। তার এভাবে চলে যাওয়া আমাদের জন্য অসহনীয়। আমরা এখন কীভাবে সংসার চালাব?” পরিবারটির আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো নয়, এবং ফজলুর রহমানই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।

স্থানীয় সমাজের মানুষেরা ফজলুর রহমানের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন এবং তাদের সহায়তার জন্য এগিয়ে আসছেন। গ্রামের মসজিদে তার জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

উপসংহার

ফজলুর রহমানের মৃত্যু শুধু তার পরিবারের জন্য নয়, পুরো মহিষাডাঙ্গা গ্রামের জন্য একটি বড় ক্ষতি। এই ঘটনা আমাদের সবাইকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সতর্কতা এবং নিরাপত্তার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। ফজলুর রহমানের মতো আর কোনো পরিবার যেন এভাবে প্রিয়জনকে হারাতে না হয়, সেজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button