সাভার-নারায়ণগঞ্জে ফের তিতাসের সাঁড়াশি অভিযান

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (১৩ মে ২০২৫) নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসব অভিযানে প্রায় ১,২০০টি আবাসিক ও শিল্প সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, যার ফলে মাসিক ২২,৬৭,৮০০ টাকার গ্যাস চুরি রোধ করা সম্ভব হবে। এছাড়া, অবৈধ সংযোগের জন্য ব্যবহৃত শত শত ফুট পাইপলাইন জব্দ করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে অভিযান: ৯০০ বাড়ির সংযোগ বিচ্ছিন্ন
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হাসিবুর রহমানের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, তিনগাও, দুপ্তারা ও আড়াইহাজার এলাকায় পাঁচটি স্পটে অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ৯০০টি বাড়ির ১,২০০টি আবাসিক চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। অভিযানের সময় বিভিন্ন ব্যাসের ৭০০ ফুট পাইপলাইন অপসারণ করে জব্দ করা হয় এবং অবৈধ বিতরণ লাইনের সংযোগ উৎস কিলিং করা হয়।
এছাড়া, নারায়ণগঞ্জের মেসার্স ভয়েজার কম্পোজিট নামে একটি প্রতিষ্ঠান বাইপাস লাইনের মাধ্যমে অবৈধভাবে গ্যাস ব্যবহার করছিল। অভিযানে এই প্রতিষ্ঠানের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তিত constructsাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ ধরনের অবৈধ সংযোগ শুধু গ্যাসের অপচয়ই নয়, বরং নিরাপত্তার জন্যও হুমকি। অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন, যারা অভিযানের সুষ্ঠু পরিচালনায় সহযোগিতা করেন।
সাভারে শিল্প সংযোগের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ
একই দিনে সাভারের দক্ষিণ রামচন্দ্রপুর, রাজফুলবাড়ীয়া, কর্ণপাড়া ও উলাইল এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদে আরেকটি অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানে দুটি শিল্প প্রতিষ্ঠান—একতা ওয়াশিং প্ল্যান্ট (দক্ষিণ রামচন্দ্রপুর, রাজফুলবাড়ীয়া) এবং মেসার্স ডিপজল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ (উলাইল)—এর অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের অবৈধ সংযোগের কারণে প্রতি মাসে ২২,৬৭,৮০০ টাকার গ্যাস চুরি হচ্ছিল।
অভিযানের সময় ৫০ ফুট লাইন পাইপ অপসারণ করে জব্দ করা হয়। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই অভিযানের ফলে শিল্প খাতে গ্যাসের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে, যা দেশের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থার স্থিতিশীলতায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। সাভারের অভিযানেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহযোগিতা প্রদান করে, যা অভিযানকে আরও কার্যকর করেছে।
কিশোরগঞ্জে বকেয়া আদায়ে বিশেষ অভিযান
একই দিনে জোবিঅ-কিশোরগঞ্জ ও রাজস্ব উপ-শাখা কিশোরগঞ্জে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানে বকেয়া বিল পরিশোধ না করার কারণে পাঁচটি আবাসিক গ্রাহকের মোট আটটি চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বকেয়া আদায়ে এ ধরনের অভিযান নিয়মিতভাবে পরিচালিত হবে, যাতে গ্রাহকরা সময়মতো বিল পরিশোধে উৎসাহিত হন।
তিতাসের চলমান প্রচেষ্টা
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে আসছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পরিচালিত অভিযানে ১৯,০৭৭টি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৪৯টি শিল্প, ৯৪টি বাণিজ্যিক এবং ১৮,৮৩৪টি আবাসিক সংযোগ রয়েছে। এসব অভিযানে ৯৫ কিলোমিটার পাইপলাইন অপসারণ করা হয়েছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৫৫টি অভিযানে ২৭টি মামলা দায়ের করা হয় এবং ১১ লাখ ১ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। এছাড়া, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁও এলাকায় ১,০০০টি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং দুই লাখ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়। তিতাস গ্যাসের এই কঠোর পদক্ষেপ অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
অবৈধ সংযোগের ঝুঁকি
অবৈধ গ্যাস সংযোগ শুধু গ্যাসের অপচয়ই নয়, এটি জননিরাপত্তার জন্যও মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে। তিতাস গ্যাসের সাভার জোনাল বিপণন অফিসের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী আবু সাদাৎ মোহাম্মদ সায়েম জানিয়েছেন, অবৈধ সংযোগগুলো প্রায়ই নিম্নমানের পাইপ ব্যবহার করে টানা হয়, যা ফুটো বা বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে। এছাড়া, অবৈধ সংযোগের কারণে তিতাস গ্যাসের শত শত কোটি টাকার রাজস্ব হ্রাস পায়, যা জাতীয় অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর।
সরকারি সহযোগিতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
তিতাস গ্যাসের এসব অভিযানে জেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দুদকের অভিযানে সাভার ও গাজীপুরে ১৫০টি অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, যেখানে তিতাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদে তাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং এই কাজে সরকারি সংস্থাগুলোর সহযোগিতা আরও জোরদার করা হবে।
গ্রাহকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বলেছে, অবৈধ সংযোগের পরিবর্তে বৈধ সংযোগ গ্রহণ করুন এবং সময়মতো বিল পরিশোধ করুন। এতে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন থাকবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।
উপসংহার
তিতাস গ্যাসের এই সাঁড়াশি অভিযান অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা। নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের অভিযানে ১,২০০টিরও বেশি সংযোগ বিচ্ছিন্ন এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জরিমানা আদায়ের মাধ্যমে তিতাস গ্যাস তার দায়িত্ব পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ ধরনের অভিযান জাতীয় সম্পদ রক্ষা, গ্যাসের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং রাজস্ব বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।