আঞ্চলিক

মেট্রো স্টেশনের সামনে অটোরিকশার অবৈধ সাম্রাজ্য

রাজধানীর স্বপ্নের মেট্রোরেল চালুর পর দ্রুত ও আরামদায়ক ভ্রমণের সুযোগ তৈরি হলেও, এর স্টেশনগুলোর সামনের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্টেশনগুলোর প্রবেশপথ এবং সংলগ্ন সড়কগুলো যেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার এক অঘোষিত সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে। যাত্রী ওঠানামার জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকা এই অটোরিকশাগুলো মূল সড়ক দখল করে রাখায় ভয়াবহ যানজট ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে মেট্রোরেল ব্যবহারকারী যাত্রী এবং সাধারণ পথচারীদের পোহাতে হচ্ছে চরম ভোগান্তি। এই পরিস্থিতি নিরসনে মেট্রো কর্তৃপক্ষ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা চেয়ে আবেদন জানিয়েছে।

সরেজমিনে বিশৃঙ্খলা চিত্র: আগারগাঁও, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০ সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মেট্রোরেল স্টেশনের সামনে সরেজমিনে গিয়ে এই বিশৃঙ্খল চিত্র দেখা গেছে। বিশেষ করে ব্যস্ত সময়ে এই স্টেশনগুলোর সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার বা বাসে করে আসা যাত্রীদের স্টেশনে নামতে বা স্টেশনে যাওয়ার পথেও ব্যাপক ভোগান্তি পোহাতে হয়। অটোরিকশাগুলো এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে যে মূল প্রবেশপথ প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে যায়। ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও অনেক সময় এই যানজট নিয়ন্ত্রণে তাদের কার্যকর ভূমিকা চোখে পড়ে না।

যাত্রী ও পথচারীদের ক্ষোভ: মেট্রোরেল স্টেশনের সামনে অটোরিকশার এমন অবস্থানের কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিয়মিত যাত্রী, বাইকার এবং প্রাইভেটকার চালকেরা। আগারগাঁও স্টেশন থেকে উত্তরাগামী যাত্রী আজফার ঢাকা মেইলকে বলেন, মেট্রোরেলে যাতায়াতে সময় বাঁচলেও স্টেশনের বাইরে অটোরিকশার কারণে যে ভোগান্তি হয়, তাতে পুরো সুবিধাটাই ম্লান হয়ে যায়। তিনি মনে করেন, যাত্রীদের নির্বিঘ্ন যাতায়াত নিশ্চিত করতে প্রতিটি স্টেশনের সামনে সুপরিকল্পিত পার্কিং ব্যবস্থা এবং অটোরিকশার জন্য নির্ধারিত স্ট্যান্ড থাকা জরুরি। একই সাথে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কঠোরতা এবং নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাইকার অভিযোগ করে বলেন, তারা বাইকে করে স্টেশনে আসতে চাইলেও জ্যামে আটকে যান। অনেক সময় অটোরিকশা চালকরা ইচ্ছে করেই রাস্তা আটকে রাখে। কাজীপাড়া মেট্রো স্টেশনের সামনে পথচারী আব্দুল হামিদ জানান, অটোরিকশার কারণে স্টেশনের সামনে হাঁটারও জায়গা থাকে না। তারা এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে যে যাত্রী নামা বা ওঠা খুব কঠিন হয়ে যায়, বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন।

মিরপুর ১০ মেট্রো স্টেশনের সামনে প্রাইভেটকার চালক জীবন বলেন, স্টেশনের সামনেটা দেখে মনে হয় যেন এটা অটোরিকশার নিজস্ব স্ট্যান্ড। এমনিতেই এই মোড়ে সারাদিন যানজট লেগে থাকে, তার উপর অটোরিকশা চালকদের এমন বিশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে যানজট আরও তীব্র হয়, সময় নষ্ট হয় এবং দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ে।

অটোরিকশা চালকদের বক্তব্য: মেট্রো স্টেশনগুলোর সামনে অপেক্ষমাণ কয়েকজন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, যাত্রী পেতেই তারা এখানে দাঁড়িয়ে থাকেন। মেট্রোরেল থেকে নামার পর যাত্রীরা সাধারণত এখানেই গাড়ির সন্ধান করেন। তারা সামনে না থাকলে যাত্রীরা যেমন রিকশা পাবেন না, তেমনি তারাও যাত্রী হারাবেন। আগারগাঁও স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আব্দুর রহিম নামের এক চালক বলেন, তাদের রিকশা রাখার কোনো নির্ধারিত জায়গা নেই। কোথায় দাঁড়াবেন সেই ব্যবস্থাও কেউ করে দেয়নি। রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকার কারণে সবাই তাদের রাস্তা দখলদার বলে অভিযোগ করেন। তিনি আরও বলেন, এখানে অনেক সরকারি অফিসের গাড়িও রাস্তার উপর রাখা হয়, কিন্তু সেগুলো নিয়ে কেউ কথা বলে না। তাদের গাড়ি না রাখলে জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়বে। তারা বিশৃঙ্খলা চান না, কিন্তু জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়েই রাস্তায় দাঁড়াতে হয়।

মেট্রো কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ: মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) এই সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে ডিএমটিসিএল এর পরিচালক (প্রশাসন) এ কে এম খায়রুল আলম ঢাকা মেইলকে জানান, স্টেশনগুলোতে ম্যাজিস্ট্রেট পদায়নের জন্য তারা মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পেতে কিছুটা সময় লাগতে পারে বিধায় তারা ঢাকার জেলা প্রশাসক এবং ডিএমপি কমিশনারকেও অটোরিকশাগুলো সরানোর জন্য চিঠি দিয়ে যোগাযোগ করেছেন। এছাড়া তাদের নিজস্ব এমআরটি পুলিশও এ বিষয়ে কাজ করছে বলে তিনি জানান।

সিটি কর্পোরেশন ও বিশেষজ্ঞদের মতামত: মেট্রোরেল স্টেশনের সামনের সড়ক থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা সরাতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহীদুল ইসলাম বলেন, তারা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছেন। তবে তারা গেলে অটোরিকশাগুলো সরে গেলেও কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে। তিনি জানান, তারা এ বিষয়ে আরও কঠোর হবেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এবং বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হক এই সমস্যাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার ফল হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করে, কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় দুর্বল ও অক্ষম হয়। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) যাদের রাস্তায় চলার নিবন্ধন দেয়, সেই দায়িত্ব তারা সঠিকভাবে পালন করে না। তারা শুধু নিবন্ধন দিয়েই যায়। ড. হক মনে করেন, সরকার আসে-যায়, কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যায়। যদি প্রতিষ্ঠানগুলো সক্ষম না হয়, দুর্বল থাকে এবং তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, যদি সক্ষম প্রতিষ্ঠান তৈরি করা না যায়, তাহলে এদের নিয়ন্ত্রণ করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। অটোরিকশার সংখ্যা বেশি হলে পুলিশ দিয়েও এদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন।

উপসংহার: মেট্রোরেল রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেও স্টেশনগুলোর সামনের অটোরিকশার অবৈধ দখলদারিত্ব এই সেবার সম্পূর্ণ সুফল প্রাপ্তিতে বাধা সৃষ্টি করছে। যাত্রী ও পথচারীদের ভোগান্তি কমাতে এবং যানজট নিরসনে মেট্রো কর্তৃপক্ষ, সিটি কর্পোরেশন, ট্রাফিক পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। একই সাথে অটোরিকশা চালকদের জন্য নির্ধারিত পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং বিআরটিএ’র মতো প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button