আঞ্চলিক

১০ টাকায় ১০ কেজি আম ঘরে পৌঁছাবে! ডাক বিভাগের ‘স্পিডপোস্ট’ সার্ভিসে

বাংলাদেশ ডাক বিভাগ চালু করেছে বিশেষ ‘স্পিডপোস্ট’ সার্ভিস—মাত্র ১০ টাকায় ১০ কেজি আম ৪৬ জেলায় পৌঁছাবে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। এতে কৃষক, বিক্রেতা ও ভোক্তা—সবাই উপকৃত হবেন। বিস্তারিত জেনে নিন এই পরিবর্তনের প্রভাব ও পরিকল্পনা।

বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দেশের ফলপ্রেমীদের জন্য এক অনন্য উদ্যোগ চালু করেছে। ‘স্পিডপোস্ট’ নামে একটি বিশেষ পরিষেবার আওতায় এবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে দেশের ৪৬টি জেলায় ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবে রাজশাহীর বিখ্যাত সুস্বাদু আম। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো—মাত্র ১০ টাকায় প্রথম ১০ কেজি আম পাঠানো যাবে। এরপর প্রতি অতিরিক্ত কেজির জন্য খরচ হবে ৫ টাকা।

ডাক বিভাগের এই পদক্ষেপ শুধু একটি পরিবহন সেবা নয়, বরং এটি দেশের কৃষি ও ডিজিটাল ব্যবসায়িক পরিবেশে একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে যাচ্ছে।

স্পিডপোস্টে কীভাবে যাবে আম?

চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান ডাকঘরের পোস্টমাস্টার মো. সারোয়ার জাহান জানান, ‘স্পিডপোস্ট’ সার্ভিসে প্রথম ১০ কেজির জন্য পরিবহন খরচ রাখা হচ্ছে মাত্র ১০ টাকা। অতিরিক্ত প্রতি কেজিতে যোগ হবে ৫ টাকা করে। ২৫টি জেলায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এবং বাকি ২১টি জেলায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আম পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

গ্রাহকের সুবিধার্থে অনলাইন ট্র্যাকিং সুবিধাও থাকবে, যার মাধ্যমে চাষি বা বিক্রেতা সরাসরি জানতে পারবেন, তাদের পাঠানো আম কোথায় পৌঁছেছে বা কোন অবস্থায় রয়েছে।


চাষি ও বিক্রেতাদের কী বলছেন?

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কৃষকদের মুখে এখন নতুন আশার আলো। কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক বলেন, “ডাক বিভাগের এই সেবা কৃষকের খরচ কমাবে, লাভ বাড়াবে এবং বাজারে আমের দামও নাগালের মধ্যে রাখবে। এটা এক ধরনের বিপ্লব।”

একই কথা বলেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. ইয়াছিন আলী। তার মতে, “শুধু উৎপাদন করলেই হবে না, বাজারজাতকরণ যদি সহজ ও সাশ্রয়ী না হয়, তাহলে কৃষক লাভবান হতে পারে না। এই উদ্যোগ সেই সমস্যার বড় সমাধান হতে পারে।”


অনলাইন উদ্যোক্তারা কী বলছেন?

আম বিক্রির সবচেয়ে বড় একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠছে অনলাইন মার্কেটপ্লেস। ফলে অনেক চাষি সরাসরি ফেসবুক, ওয়েবসাইট বা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্রেতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন পণ্য। সেখানে পরিবহন খরচ ও ডেলিভারি সময় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

অনলাইন আম বিক্রেতা গোলাম মোস্তফা সুমন বলেন, “ডাক বিভাগের এই সেবা নিয়মিত ও সঠিকভাবে পরিচালিত হলে আমরা অনেক উপকৃত হবো। তবে অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, পরিবহনের জন্য গাড়ির ঘাটতি ও জনবলের অভাব ছিল। সেগুলোর সমাধান করতে হবে।”


কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্যোগ?

গত বছর ডাক বিভাগের আম পরিবহন সেবা সাময়িক বন্ধ রাখতে হয়েছিল গাড়ির সংকটের কারণে। তাই এবার তারা বিশেষ প্রস্তুতি নিয়েছে। নতুন করে বাড়ানো হয়েছে পরিবহন ব্যবস্থার সক্ষমতা—যার মধ্যে রয়েছে:

  • অতিরিক্ত গাড়ি সংযুক্তি
  • ট্রেনযোগে পরিবহনের পরিকল্পনা
  • ডাকঘরে জনবল বৃদ্ধি
  • প্যাকেজিং ও ডেলিভারির দক্ষ ব্যবস্থাপনা

ডাক বিভাগ আশাবাদী যে, এই মৌসুমে তারা সময়মতো ও নিরাপদে আম পৌঁছে দিতে পারবে। এটি সফল হলে, ভোক্তার আস্থা যেমন বাড়বে, তেমনি রাষ্ট্রীয় সেবার গ্রহণযোগ্যতাও আরও বাড়বে।


কুরিয়ার সার্ভিস বনাম ডাক বিভাগ

বেসরকারি কুরিয়ারে আম পরিবহনের খরচ তুলনামূলক অনেক বেশি। সাধারণত ১০ কেজি আম পাঠাতে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়ে যায়। কিন্তু ডাক বিভাগের নতুন পরিকল্পনায় এই খরচ মাত্র ১০ টাকা—যা একজন কৃষকের জন্য বিশাল স্বস্তি।

এছাড়াও ডাক বিভাগের সেবায় এখন আধুনিক প্রযুক্তি ও অনলাইন ট্র্যাকিং যুক্ত হওয়ায় নিরাপত্তা ও গন্তব্য নিশ্চয়তার দিক থেকেও এটি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে।


রাজশাহীর আম কেন জনপ্রিয়?

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের আম দেশের সবচেয়ে সুস্বাদু ও জনপ্রিয় ফলগুলোর একটি। ফজলি, ল্যাংড়া, হিমসাগর, আম্রপালি প্রভৃতি জাতের আম এই অঞ্চলেই উৎপন্ন হয়।

চাষিরা বলছেন, আগে আম পরিবহনে খরচ বেশি হওয়ায় তারা চুক্তিভিত্তিক বিক্রি করতেন বা মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে বিক্রি করতেন। এখন নিজেরাই সরাসরি ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে পারবেন। ফলে লাভও বেশি থাকবে।


বাজার ও ভোক্তাদের উপকার

নিম্ন পরিবহন খরচের ফলে ভোক্তার কাছেও কম দামে আম পৌঁছানো সম্ভব হবে। যেখানে অনলাইনে প্রতি কেজি আম কিনতে ১০০ টাকার উপরে দিতে হয়, সেখানে এই সেবার কারণে দাম ৬০-৭০ টাকার মধ্যে রাখা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অনেকে।

এতে একদিকে অনলাইন বিক্রি বাড়বে, অন্যদিকে শহরের মানুষ ঘরে বসেই গ্রামের টাটকা আম উপভোগ করতে পারবেন।


টেকসই ব্যবস্থাপনার দাবি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই উদ্যোগ স্থায়ীভাবে চালু রাখতে হলে কিছু বিষয় নিশ্চিত করতে হবে:

  • সঠিক সময়মতো ডেলিভারি
  • প্যাকেজিংয়ে আমের নিরাপত্তা বজায় রাখা
  • জনবল ও যানবাহন প্রস্তুতির সক্ষমতা
  • অনলাইন পেমেন্ট ও ট্র্যাকিং আরও সহজ করা

ডাক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা এসব বিষয় মাথায় রেখেই এবারের পরিকল্পনা করেছেন।


উপসংহার

বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ‘স্পিডপোস্টে’ আম পরিবহন সেবা শুধু একটি সরকারি উদ্যোগ নয়, এটি কৃষি বিপণন ও ডিজিটাল ব্যবসার যুগান্তকারী রূপান্তরের সূচনা। এতে চাষি, বিক্রেতা ও ভোক্তা—সবাই উপকৃত হবেন। পরিবহন খরচ কমবে, সময় বাঁচবে এবং রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী আম আরও সহজে পৌঁছে যাবে দেশের প্রতিটি ঘরে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button