আঞ্চলিক

খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ১৯০টি গাড়ি জব্দের নির্দেশ

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে আদালত ১৯০টি গাড়ি জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন। রোববার (৪ মে) ঢাকার মেট্রোপলিটন সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের বিচারক মো. জাকির হোসেন এই আদেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্ত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই পদক্ষেপ নেন।

দুদক জানায়, খন্দকার এনায়েত উল্লাহ এবং তার পরিবার—স্ত্রী নার্গিস সামশাদ, ছেলে রিদওয়ানুল আশিক নিলয় ও মেয়ে চাশমে জাহান নিশির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী যানবাহন থেকে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ তদন্তাধীন রয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ অবৈধ আয়ের মাধ্যমে তারা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নামে জমি, ফ্ল্যাট, প্লট এবং গাড়ি কিনেছেন বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে।

দুর্নীতির ছায়ায় প্রভাবশালী ব্যক্তি

দুদকের উপপরিচালক ও তদন্ত দলের প্রধান মো. সাইফুজ্জামান আদালতে দাখিলকৃত আবেদনে বলেন, এনায়েত উল্লাহর মালিকানাধীন গাড়িগুলোর বেশিরভাগই বিভিন্ন পরিবহন সংস্থার নামে থাকলেও সেগুলোর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই। এমনকি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের উৎস নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, গোপন সূত্রে দুদক জানতে পারে যে, অভিযুক্তরা ইতোমধ্যে গাড়িগুলো বিক্রি করে বিদেশে পালানোর পরিকল্পনা করছেন। ফলে এসব গাড়ি জব্দের নির্দেশনা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে তদন্তের অগ্রগতি

২০২৪ সালের ১৪ জানুয়ারি এনায়েত ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করে দুদক। এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ ফেব্রুয়ারি আদালতে আবেদনের পর তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে যুক্তি ছিল যে, তারা যেকোনো সময় দেশ ত্যাগ করে আইনের আওতার বাইরে চলে যেতে পারে।

দুদকের আবেদনে আরও বলা হয়, এনায়েত উল্লাহ সড়ক পরিবহন খাতের প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মালিক সমিতির পদ দখলে রেখেছেন। এই প্রভাবকে ব্যবহার করেই তিনি মাসের পর মাস অবৈধ অর্থ উপার্জন করে চলেছেন।

গাড়ি জব্দের নির্দেশের আইনগত গুরুত্ব

আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, এখন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও ট্রাফিক বিভাগকে সমন্বয় করে দ্রুত এই ১৯০টি গাড়ি জব্দের কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। এই নির্দেশনার মাধ্যমে দেশের বিচারব্যবস্থা প্রমাণ করেছে যে, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন—even প্রভাবশালী সাবেক নেতা হলেও।

এটি দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমকে নতুন গতিপথে নিয়ে যাবে বলে অভিজ্ঞ মহলের অভিমত। কারণ সাধারণত এত বৃহৎ পরিসরে গাড়ি জব্দের নির্দেশনা দেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এর ফলে পরিবহন খাতে বিদ্যমান অনিয়ম ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কার্যকর বার্তা পৌঁছে যাবে।

সড়ক পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির চিত্র

পরিবহন খাত দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন অনিয়ম ও চাঁদাবাজির অভিযোগে জর্জরিত। প্রতিদিন সড়কে চলাচলকারী বাস, মিনিবাস ও ট্রাক মালিকদের কাছ থেকে নামমাত্র অজুহাতে টাকা আদায় করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অর্থের কোনো হিসাব না থাকলেও বহু নেতা ও সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের লোকজনের জীবনযাত্রায় এসব আয়ের ছাপ স্পষ্ট।

খন্দকার এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগ সেই দীর্ঘদিনের অভিযোগকে আরও প্রমাণিত করেছে যে, প্রভাব খাটিয়ে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর থেকেই লুটপাট চলে আসছে। তার মালিকানাধীন এসব গাড়ি বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির ব্যানারে চললেও তাদের আয়ের বেশিরভাগই ব্যক্তিগত পকেটে চলে যাচ্ছে।

দুদকের অবস্থান ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

দুদক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গাড়ি জব্দ ছাড়াও এনায়েত ও তার পরিবারের নামে থাকা সকল অস্থাবর ও স্থাবর সম্পদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সেইসঙ্গে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, বৈদেশিক লেনদেন এবং ট্যাক্স রিটার্নও খতিয়ে দেখা হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই তদন্ত যদি নিরপেক্ষভাবে শেষ করা যায় এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুত চার্জশিট দাখিল হয়, তবে তা দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংগ্রামে বড় ধরনের উদাহরণ সৃষ্টি করবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ ও ভবিষ্যৎ কর্মকর্তাদের জন্য এটি একটি বার্তা দেবে যে, দুর্নীতির ফল কখনোই মধুর হয় না।

উপসংহার:
খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে আদালতের এই জব্দ আদেশ শুধু একটি মামলার অংশ নয়, বরং তা দেশে চলমান দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত আরও জোরালোভাবে কার্যকর করা প্রয়োজন, যাতে দুর্নীতিবাজরা ভবিষ্যতে অপরাধ করার সাহস না পায়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button