বাসাবাড়িতে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশু নিয়োগ বন্ধে আইন করার সুপারিশ

বাসাবাড়িতে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের গৃহকর্মে নিয়োগ বন্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও তার কার্যকর বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন। এছাড়া, গৃহশ্রমিক ও বিউটি পারলার খাতের কর্মীদের অধিকার, সুরক্ষা, এবং সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে কমিশনের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া এই প্রতিবেদনটি শ্রমিকদের কল্যাণে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
শিশুশ্রম নিষিদ্ধকরণে কঠোর পদক্ষেপ
বাংলাদেশ জাতীয় শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজে নিয়োগ শিশুশ্রম হিসেবে গণ্য। একইভাবে, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি ২০১৫-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এই বয়সের শিশুদের গৃহকর্মে নিয়োগ করা যাবে না। তবে, এই নীতিমালার বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শ্রম সংস্কার কমিশন তাই কঠোর আইন প্রণয়নের পাশাপাশি তার কার্যকর প্রয়োগের উপর জোর দিয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশুশ্রম বন্ধে আইনি কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা এবং সহজলভ্য প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন। এছাড়া, শিশুদের শিক্ষা ও সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সচেতনতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ কেন গুরুত্বপূর্ণ? শিশুরা যখন অল্প বয়সে কাজে নিয়োজিত হয়, তখন তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশুরা প্রায়ই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। এই প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে, শিশুদের অধিকার সুরক্ষিত হবে এবং সমাজে দারিদ্র্যের চক্র ভাঙতে সাহায্য করবে।
গৃহশ্রমিকদের অধিকার ও মর্যাদা
গৃহশ্রমিকদের বাংলাদেশ শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করে তাদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন। এর আগপর্যন্ত গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি ২০১৫-এর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, আবাসিক, অনাবাসিক, খণ্ডকালীন, বা স্থায়ী—সব ধরনের গৃহশ্রমিকদের জন্য কর্মঘণ্টা, বেতন, ছুটি, এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে একটি বাধ্যতামূলক কর্মসংস্থান চুক্তি প্রণয়ন করতে হবে।
এই চুক্তিতে গৃহশ্রমিকদের অভিযোগ দায়েরের প্রক্রিয়াও স্পষ্ট করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো শ্রমিক যদি নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চান, তবে তিনি কোথায়, কীভাবে, এবং কার কাছে এই অভিযোগ দায়ের করবেন—এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। এছাড়া, গৃহশ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। এই প্রশিক্ষণ তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াবে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
কমিশন আরও পরামর্শ দিয়েছে যে, গৃহশ্রমিকদের সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার প্রদান করা উচিত। এটি তাদের সমষ্টিগতভাবে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করার ক্ষমতা দেবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ধরনের পদক্ষেপ গৃহশ্রমিকদের সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে এবং তাদের শোষণ থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিউটি পারলার শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা
শ্রম সংস্কার কমিশন বিউটি পারলার খাতের শ্রমিকদের জন্যও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরেছে। এই খাতের কর্মীদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আনার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই খাতে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গঠন করতে হবে, যা কর্মীদের কাজের মান ও ঝুঁকি বিবেচনায় মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করবে। এছাড়া, কর্মীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পদোন্নতির সুযোগ তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো কর্মীদের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এবং তাদের পেশাগত মর্যাদা বাড়াবে।
বিউটি পারলারের কর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) প্রদান এবং নিরাপত্তা নির্দেশিকা প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া, অনেক কর্মী রাতে বাসায় ফেরেন, তাই তাদের কর্মক্ষেত্রে এবং বাড়ি ফেরার সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কমিউনিটিভিত্তিক উদ্যোগের মাধ্যমে এই শ্রমিকদের হয়রানি প্রতিরোধ ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা যেতে পারে বলে মনে করে কমিশন।
সমাজে প্রভাব ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
শ্রম সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে, বাংলাদেশের শ্রম খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। শিশুশ্রম বন্ধ করা শুধু শিশুদের অধিকার রক্ষা করবে না, বরং সমাজে শিক্ষার হার বাড়াতে এবং দারিদ্র্য হ্রাসে সহায়তা করবে। একইভাবে, গৃহশ্রমিক ও বিউটি পারলার কর্মীদের অধিকার নিশ্চিত করা তাদের জীবনমান উন্নত করবে এবং সমাজে লিঙ্গ সমতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করবে।
তবে, এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, গৃহশ্রমিকদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগ করা কঠিন হতে পারে, কারণ বাসাবাড়িতে শ্রম পরিদর্শন করা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। একইভাবে, বিউটি পারলার খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে ছোট ব্যবসায়ীদের আপত্তি থাকতে পারে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সরকার, বেসরকারি সংস্থা, এবং সমাজের সব অংশের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।