কুমিল্লায় বজ্রপাতে শিশুসহ ৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু

কুমিল্লায় বজ্রপাতের কবলে পড়ে দুই শিশুসহ চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও দুইজন। সোমবার (২৮ এপ্রিল) সকাল ও দুপুরে মুরাদনগর ও বরুড়া উপজেলার দুটি পৃথক স্থানে এসব ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় প্রশাসন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বজ্রপাতের সময় অধিকাংশ ভুক্তভোগী মাঠে কাজ করছিলেন বা খেলাধুলার জন্য বাইরে ছিলেন।
মুরাদনগরে কৃষিকাজের সময় প্রাণ হারালেন দুইজন
সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুরাদনগর উপজেলার কোরবানপুর গ্রামে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন—কোরবানপুর গ্রামের বাসিন্দা নিখিল দেবনাথ এবং পাশের দেওরা গ্রামের বাসিন্দা জুয়েল ভূঁইয়া।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সকাল থেকে গ্রামের বেশ কিছু কৃষক মাঠে কাজ করছিলেন। হঠাৎ ঘন কালো মেঘের সঙ্গে বজ্রসহ বৃষ্টি শুরু হয়। কাজের ব্যস্ততার মধ্যে বজ্রপাতের সরাসরি আঘাতে নিখিল দেবনাথ ও জুয়েল ভূঁইয়া ঘটনাস্থলেই মারা যান।
এ সময় আহত হন আরও দুই কৃষক। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে দ্রুত মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
মুরাদনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুজ্জামান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, “বজ্রপাতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।”
বরুড়ায় ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে দুই শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু
একই দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বরুড়া উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের পয়ালগুচ্ছ গ্রামে বজ্রপাতে আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
নিহত দুই শিশু হলেন—ফরহাদ হোসেন (১২) ও সাইমন হোসেন (১২)। দুজনই স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, দুপুরের দিকে আবহাওয়া কিছুটা মেঘলা হলেও বজ্রপাতের পূর্বাভাস তেমন ছিল না। সেই সময় ফরহাদ ও সাইমন গ্রামের মাঠে ঘুড়ি উড়াতে গিয়েছিল। হঠাৎ প্রবল বজ্রসহ বৃষ্টি শুরু হয় এবং বজ্রপাতের সরাসরি আঘাতে দুজনই গুরুতর আহত হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয়রা তাদের বরুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
বরুড়া থানার ওসি মোহাম্মদ সোহেল রানা বলেন, “শিশুদের অকাল মৃত্যুতে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। পরিবারগুলোকে সব ধরনের সহায়তা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।”
এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া
দুই উপজেলার এই ঘটনায় এলাকাজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। নিহতদের বাড়িতে এখন কান্নার রোল পড়ে গেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং নিহতদের পরিবারকে সান্ত্বনা দিয়েছেন।
মুরাদনগরের কোরবানপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, “এটা খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়ার সুপারিশ করেছি।”
সতর্কতামূলক পরামর্শ
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে এপ্রিল-মে মাসে বজ্রপাতের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি থাকে।
তারা সাধারণ মানুষকে পরামর্শ দিয়েছেন, বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠ, উঁচু গাছপালা, খোলা স্থানে অবস্থান না করতে। যদি কেউ বাইরে থাকেন, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হবে।
আবহাওয়া অফিসের ডিউটি কর্মকর্তা মো. আব্দুল হালিম বলেন, “গ্রীষ্মের এই সময়ে বজ্রপাত স্বাভাবিক ঘটনা। আমরা সর্বসাধারণকে প্রতিদিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস মনিটর করার আহ্বান জানাচ্ছি।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাতের চিত্র
বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। পরিবেশবাদী সংস্থাগুলোর মতে,
- শুধুমাত্র ২০২৪ সালে দেশে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৩৫০ জনের বেশি মানুষ।
- বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বজ্রপাতের ঘটনা বাড়ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
- বজ্রপাতে নিহতদের মধ্যে কৃষক ও শিশুদের হার সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বজ্রপাতের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্দিষ্ট মৌসুমে সরকারি পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো দরকার।
কুমিল্লার মুরাদনগর ও বরুড়ায় বজ্রপাতে দুই কৃষক এবং দুই শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা আবারও সতর্ক করে দিলো যে, প্রকৃতির প্রতিকূল অবস্থাকে অবহেলা করা উচিত নয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় সতর্কতা অবলম্বন এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করলে এই ধরনের দুঃখজনক ঘটনা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব। নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও সর্বস্তরের মানুষ।