আঞ্চলিক

ফরিদপুরে বাস দুর্ঘটনায় নিহত ৭,তদন্তে উঠে এল ৫টি প্রধান কারণ

ফরিদপুর-বরিশাল মহাসড়কে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনায় সাতজন নিহতের ঘটনায় জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি আজ তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার পাঁচটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ১৪টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

কী ঘটেছিল সেদিন?

গত ৮ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে ফরিদপুর সদর উপজেলার বাখুন্ডা জোয়াইর এলাকার শরিফা জুটমিলের সামনে ‘ফারাবি এক্সপ্রেস’ নামের একটি মিনিবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যায়। দুর্ঘটনাস্থলে পাঁচজন নিহত হন এবং পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়। এ দুর্ঘটনায় আরও প্রায় ৩০ জন আহত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে কয়েকজন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত পাঁচটি কারণ

তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, দুর্ঘটনার জন্য যেসব বিষয় দায়ী, তার মধ্যে রয়েছে:

  1. চালকের বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন গতি
  2. ঝুঁকিপূর্ণ ও নিয়মবহির্ভূত ওভারটেকিং
  3. ফিটনেস ও ট্যাক্স টোকেনের মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় গাড়ি চালানো
  4. রাস্তার ঝুঁকিপূর্ণ পার্শ্বাংশে ‘সোল্ডার ড্রপ’
  5. সড়কে যথাযথ সতর্কতামূলক সাইনবোর্ডের অনুপস্থিতি

তদ্ব্যতীত, দুর্ঘটনাকবলিত বাসচালকের বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায়নি বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ফরিদপুরে অব্যবস্থাপনার চিত্র

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ফরিদপুর-ভাঙ্গা মহাসড়কের ওই অংশে অবৈধ, নিবন্ধনবিহীন ইজিবাইক, নসিমন, করিমন ও ভটভটি চলাচল করছে। এসব যানবাহন মহাসড়কে স্বাভাবিক যানচলাচলে বিঘ্ন ঘটায়, যার ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।

তদন্ত কমিটি ও সুপারিশ

দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিন্টু বিশ্বাসকে প্রধান করে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে পুলিশ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, বিআরটিএ, বুয়েট, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ছিলেন।

তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দিতে গিয়ে কমিটি ভবিষ্যতের জন্য ১৪টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • ফিটনেস ও রুট পারমিট ছাড়া কোনো যানবাহন চলতে না দেওয়া
  • টানা ৫ ঘণ্টার বেশি কোনো চালককে গাড়ি না চালাতে দেওয়া
  • বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া চালকদের সড়কে নামতে না দেওয়া
  • দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় ট্রাফিক সাইন ও সিসি ক্যামেরা বসানো
  • তিন চাকার ব্যাটারিচালিত যানবাহন মহাসড়কে নিষিদ্ধ করা
  • প্রতিটি গাড়িতে অগ্নিনির্বাপক ও গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসানো
  • ঝুঁকিপূর্ণ সড়কের সোল্ডার ড্রপ মেরামত
  • অনুমোদনহীন পার্শ্বরাস্তা বন্ধ করা
  • রাস্তায় রাইট অব ওয়েতে বৈদ্যুতিক খুঁটি অপসারণ

প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপ

জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান মোল্যা জানান,

“আগের দুর্ঘটনাগুলোর সুপারিশের সঙ্গে বর্তমান প্রতিবেদন মিলিয়ে দ্রুত সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবায়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। জাতীয় পর্যায়ের সুপারিশগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।”

চালক গ্রেপ্তার, মামলার অগ্রগতি

দুর্ঘটনার পর সড়ক পরিবহন আইনে দায়ের করা মামলায় বাসচালক সুমন গাজীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চালককে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে এবং তাঁর লাইসেন্স ও গাড়ির বৈধতা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

ফরিদপুরে বাস দুর্ঘটনার পেছনে বেপরোয়া গতি, নিয়ম না মানা এবং অব্যবস্থাপনাই মূল কারণ বলে তদন্তে উঠে এসেছে। প্রশাসন দ্রুত সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে, তবে বাস্তবায়ন কতটা কার্যকর হবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button