ফলকে নিজের নাম দেখে উপদেষ্টা বললেন, ‘এটা কি আমার বাপের টাকায় করছে?’

ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিরল এক ঘটনা ঘটলো। উদ্বোধনী নামফলকে নিজের নাম দেখে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানালেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এটা কি আমার বাপের টাকায় করছে? তাহলে কেন আমার নাম থাকবে?” মুহূর্তের মধ্যে বিষয়টি আলোচনায় আসে এবং উপস্থিত কর্মকর্তাদের দ্রুত নামফলক পরিবর্তনের নির্দেশ দেন তিনি।
ঘটনার পর নামফলক উন্মোচন না করেই কেবল ফিতা কেটে আনুষ্ঠানিকভাবে এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম ধাপ উদ্বোধন করা হয়।
অনুষ্ঠানের ঘটনা
রবিবার (২৪ আগস্ট) সকালে গাজীপুরের ভোগড়া এলাকায় নতুন টোল প্লাজা প্রাঙ্গণে এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরু হয়। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহসানুল হক, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার নাজমুল করিম খান ও গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিনসহ একাধিক কর্মকর্তা।
অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হওয়ার পরপরই টোল প্লাজার নামফলকে নিজের নাম দেখে বিস্মিত হন উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি উদ্বোধন করছি ঠিক আছে, কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমার নাম ফলকে থাকবে। প্রকল্প রাষ্ট্রের অর্থে হচ্ছে, ব্যক্তিগত অর্থে নয়।”
নামফলক না উন্মোচনের সিদ্ধান্ত
প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ জানিয়ে তিনি নামফলক উন্মোচন না করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে প্রকল্পের সময়সূচি মেনে উদ্বোধন অনুষ্ঠান যাতে ব্যাহত না হয়, সেজন্য তিনি টোল প্লাজার পাশে ফিতা কেটে এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেন। এর মধ্য দিয়ে ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম ধাপের ১৮ কিলোমিটার সড়ক যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
উপস্থিত কর্মকর্তারা জানান, উপদেষ্টার এই মন্তব্যে সবাই অবাক হলেও তার বক্তব্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার বার্তা উঠে এসেছে।
উদ্বোধনী বক্তব্যে স্বচ্ছতা ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণের আহ্বান
মঞ্চে দেওয়া বক্তব্যে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান রাস্তা নির্মাণ খাতে দুর্নীতি কমানোর উপর জোর দেন। তিনি বলেন, “আশপাশের দেশের তুলনায় আমাদের সড়ক নির্মাণের খরচ অনেক বেশি। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে নির্মাণ ব্যয় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমানো সম্ভব।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় কেবল সড়কের ওপর নির্ভর না করে রেলপথ, নদীপথ ও আকাশপথের ব্যবহার বাড়াতে হবে। এতে চাপ কমবে এবং পরিবহন খাত টেকসই হবে।
প্রকল্পের অগ্রগতি ও সময়সীমা
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য ৪৮ কিলোমিটার। ভোগড়া বাইপাস থেকে মদনপুর পর্যন্ত বিস্তৃত এই এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২২ সালের মে মাসে।
প্রকল্পের মোট ৮০ শতাংশ কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। আগামী ২০২৬ সালের জুন নাগাদ পুরো প্রকল্প হস্তান্তরের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম ধাপের ১৮ কিলোমিটার অংশ চালুর ফলে রাজধানীর সঙ্গে উত্তরবঙ্গ ও পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগে গতি আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বচ্ছতা নিয়ে ইতিবাচক বার্তা
সড়ক মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, উপদেষ্টার নামফলক না উন্মোচনের সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে সরকারি প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। অনেক সময় উদ্বোধনী ফলকে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ব্যক্তিত্বের নাম যুক্ত করে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এই ঘটনার মাধ্যমে সেই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া হলো।
একজন কর্মকর্তা বলেন, “এটা একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রীয় অর্থে করা কাজ জনগণের, কারও ব্যক্তিগত নয়।”
জনগণের প্রতিক্রিয়া
ঘটনার খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। অনেকেই উপদেষ্টার এই মন্তব্যকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন। তারা মনে করছেন, এই ধরণের দৃষ্টান্তমূলক আচরণ দেশে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে সহায়ক হবে।
একজন স্থানীয় ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা প্রায়ই দেখি সরকারি প্রকল্পের নামফলকে মন্ত্রী, এমপি বা কর্মকর্তাদের নাম থাকে। আজকের ঘটনা প্রমাণ করলো, কিছু মানুষ সত্যিই সৎ থাকতে চান।”
পরিশেষে
ঢাকা বাইপাস এক্সপ্রেসওয়ে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প। উদ্বোধনের দিনে নামফলক ঘিরে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি হলেও উপদেষ্টার অবস্থান সমাজে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। তিনি নিজেই দেখিয়ে দিলেন যে রাষ্ট্রীয় প্রকল্প জনগণের সম্পদ, কোনো ব্যক্তির নয়।
বিশ্লেষকদের মতে, ভবিষ্যতে এ ধরণের উদাহরণ বাড়লে সরকারি কাজের স্বচ্ছতা আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে মূল চ্যালেঞ্জ থেকে যাবে প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ করা এবং ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখা।
এম আর এম – ১০১৩, Signalbd.com