বিদেশ থেকে শুধু অর্থ নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক রেমিট্যান্সও চাই: জামায়াত আমিরের প্রস্তাব
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান সম্প্রতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক স্থিতিশীলতা প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমরা শুধু বিদেশ থেকে আর্থিক রেমিট্যান্স চাই না, দেশের জন্য প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তিক রেমিট্যান্সও।” অর্থাৎ, মেধাবী শিক্ষার্থী, পেশাজীবী এবং নতুন উদ্ভাবকরা বিদেশে থাকলেও তাদের জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো উচিত।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দেশে অনেক দক্ষ পেশাজীবী এবং শিক্ষার্থী বিদেশে চলে যাচ্ছেন। তাদের অনেকেই দেশে ফিরে আসতে চান না, কারণ তারা মনে করেন বাংলাদেশ তাদের সম্মান বা উপযুক্ত সুযোগ দিচ্ছে না। “সম্মানের জায়গা তৈরি করলে, তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের জন্য কাজ করবে,” তিনি উল্লেখ করেন।
চতুর্থ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য
শনিবার (২৯ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত ‘চতুর্থ বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২৫: অর্থনীতির ভবিষ্যৎ রূপরেখা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার’ শীর্ষক অধিবেশনে এই মন্তব্য করেন জামায়াত আমির।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “নীতিনিষ্ঠ, স্বচ্ছ ও ন্যায্য অর্থনৈতিক কাঠামো ছাড়া একটি দেশ এগোতে পারে না।” তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন স্তরে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি এবং ব্যবসার অনিশ্চয়তা উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার অভাব দেখে এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নন। অনেক শিল্পপতি নিরাপত্তার কারণে তাদের সন্তানদের বিদেশে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন। ডা. শফিকুর রহমান প্রশ্ন তোলেন, “একজন বাবা হিসেবে সন্তানকে নিরাপদ রাখতে চাওয়া কি দোষ?”
তিনি বলেন, “সমাজ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ, তাই মানুষ দেশ ছাড়ছে। আমরা যদি সত্যিই উন্নত ও স্থিতিশীল বাংলাদেশ চাই, তবে সমাজের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার এবং সুযোগ সুবিধার সমান ভাগ নিশ্চিত করতে হবে।”
সমাজ ও অর্থনীতির উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি
ডা. শফিকুর রহমান মনে করেন, একটি শক্তিশালী সমাজ গড়ে তুলতে তিনটি ক্ষেত্রকে ঠিক করতে হবে:
- শিক্ষা ব্যবস্থা:
তিনি বলেন, “শুধু সার্টিফিকেট নয়, প্রয়োজন স্কিল এবং পেশাভিত্তিক শিক্ষা।” অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তারা দেশের শিল্প, প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন সেক্টরে যোগ্যতা ও উদ্ভাবন নিয়ে অবদান রাখতে পারে। - দুর্নীতি দমন:
তিনি বলেন, “দুর্নীতি দমনে শুধু ডালপালা নয়, মূল শিকড় কেটে ফেলতে হবে।” অর্থাৎ ন্যায্য ও স্বচ্ছ প্রশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং সরকারি খাতের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। - ন্যায্য বিচার:
সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, “যেখানে বিচার নেই, সেখানে বিনিয়োগও থাকে না। যেখানে বিনিয়োগ নেই, সেখানে উন্নয়ন আসে না।”
ডা. শফিকুর রহমান আরও বলেন, দেশের জন্য অর্থনৈতিক পতন বা নৈতিক অবক্ষয় কোনোটিই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি যোগ করেন, “রাজনৈতিক আন্তরিকতা হলো সংস্কারের মূল চাবিকাঠি।” অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতা ও দলগুলোর দায়িত্বশীল ভূমিকা দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অপরিহার্য।
দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, “চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে অনীহা দেখাচ্ছেন।”
- স্থানীয় ব্যবসায়ীর নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না হলে তারা বিদেশে চলে যেতে বাধ্য।
- বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা দেখে বিনিয়োগের জন্য নিরাপত্তাহীন বোধ করেন।
- দেশের অর্থনীতি ও শিল্প-বাণিজ্য চর্চা করতে হলে স্থিতিশীল, স্বচ্ছ ও নিরাপদ পরিবেশ অপরিহার্য।
ডা. শফিকুর রহমান আরও উল্লেখ করেন, “শুধু অর্থনৈতিক উদ্ভাবক নয়, শিক্ষিত ও দক্ষ পেশাজীবীদেরও দেশে ফিরে আসার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সম্মান, সুযোগ এবং ন্যায্যতা না থাকলে তারা ফিরবে না।”
দেশের স্থিতিশীল সমাজ গঠনের দিকনির্দেশনা
ডা. শফিকুর রহমান সমাজ গঠনের জন্য তিনটি মূল দিকের ওপর জোর দেন:
- শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন:
- শিক্ষার্থীদের পেশাগত দক্ষতা ও উদ্ভাবন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
- শুধু সার্টিফিকেট নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা ও স্কিল তৈরি করা।
- দুর্নীতি রোধ:
- মূল শিকড় থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা।
- সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।
- ন্যায্য বিচার নিশ্চিতকরণ:
- আইন এবং সামাজিক ব্যবস্থা সকলের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য করা।
- বিচারপ্রণালীর স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখা।
তিনি বলেন, “এগুলো না হলে কোনো দেশ এগোতে পারে না। সমাজকে টিকিয়ে রাখতে হলে শিক্ষার মান উন্নয়ন, দুর্নীতি দমন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।”
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য
অধিবেশনে আরও বক্তব্য রাখেন:
- বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
- বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী
- এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম
- গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি
- জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার
এরা সবাই দেশীয় অর্থনীতি, সামাজিক নিরাপত্তা এবং রাজনৈতিক সংস্কার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেবল আর্থিক বিনিয়োগ বা রেমিট্যান্সে সীমাবদ্ধ নয়।
- মেধাবী মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা এবং উদ্ভাবন দেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন।
- রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
- সামাজিক নিরাপত্তা এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত হলে বিদেশে থাকা পেশাজীবী ও শিক্ষার্থীরাও দেশে ফিরে আসবে।
ডা. শফিকুর রহমানের বার্তা দেশের রাজনীতি, শিক্ষা ও ব্যবসা ক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধ, দক্ষতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বিশেষ প্রাসঙ্গিক।
- বুদ্ধিবৃত্তিক রেমিট্যান্স অর্থনৈতিক প্রগতি ও সামাজিক উন্নয়নে অপরিহার্য।
- দক্ষ পেশাজীবী ও শিক্ষার্থীরা সম্মান ও সুযোগ পেলে দেশে ফিরতে ইচ্ছুক।
- শিক্ষা, দুর্নীতি দমন, ন্যায্য বিচার দেশের স্থিতিশীলতার মূল চাবিকাঠি।
- রাজনৈতিক আন্তরিকতা ছাড়া সংস্কার সম্ভব নয়।
MAH – 14056 I Signalbd.com


