রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের একটি আবাসিক ফ্ল্যাটে মা ও মেয়েকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় বাসায় নতুন কাজে আসা গৃহপরিচারিকা আয়েশাকে সন্দেহের তালিকায় রেখে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের পর গৃহকর্মী নিহত কিশোরীর স্কুলড্রেস পরে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। গৃহকর্তা এম জেড আজিজুল ইসলাম সোমবার সকালে কাজে বের হওয়ার পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এসে স্ত্রী ও মেয়েকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে হত্যায় ব্যবহৃত দুটি ধারালো ছুরি বাথরুমের বালতির ভেতর থেকে উদ্ধার করেছে। প্রাথমিক ধারণা, চুরির উদ্দেশ্যেই এই জোড়া হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
নিহতদের পরিচয় ও ঘটনার বিবরণ
জোড়া হত্যাকাণ্ডের শিকার মা ও মেয়ে মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের ৩২/২/এ ভবনের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন।
- নিহতরা:
- মালাইলা আফরোজ (৪৮): গৃহিণী।
- নাফিসা বিনতে আজিজ (১৫): মোহাম্মদপুরের প্রিপারেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
- গৃহকর্তা: নাফিসার বাবা এম জেড আজিজুল ইসলাম উত্তরার সানবিমস স্কুলের ফিজিক্সের শিক্ষক।
সোমবার সকাল ৭টার দিকে আজিজুল ইসলাম কাজের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যান। এরপর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তিনি বাসায় ফিরে এসে স্ত্রী ও মেয়েকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পান। মেয়ে নাফিসাকে জীবিত অবস্থায় পেলেও হাসপাতালে নেওয়ার পর সে মারা যায়। মালাইলা আফরোজকে ঘটনাস্থলেই মৃত ঘোষণা করা হয়।
গৃহকর্মী ‘আয়েশা’: সন্দেহ ও সিসিটিভি ফুটেজ
পুলিশের সন্দেহের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মাত্র চার দিন আগে কাজে আসা গৃহপরিচারিকা আয়েশা (ছদ্মনাম)।
- পরিচয়: আনুমানিক ২০ বছর বয়সী ওই নারী নিজেকে আয়েশা পরিচয় দিয়েছিল। সেসময় নিজের গ্রামের বাড়ি রংপুর এবং জেনেভা ক্যাম্পের একটি ঠিকানার কথা জানিয়েছিল। গৃহকর্তা জানান, মেয়েটির শরীরে আগুনে পোড়ার ক্ষতও ছিল।
- সিসিটিভি বিশ্লেষণ: ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নাফিসার বাবা সকাল ৭টার দিকে বের হওয়ার পর সকাল ৯টা ৩৫ মিনিট ৫৭ সেকেন্ডে গৃহপরিচারিকা আয়েশা একটি কালো রঙের স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এবং সাদা স্কুল ড্রেস পরে লিফট থেকে বের হন। এসময় তার মুখে মাস্ক পড়া ছিল।
- পলায়নের কৌশল: অন্য একটি ফুটেজে দেখা যায়, দারোয়ান তাকে গেট খুলে দেন এবং সে নির্দ্বিধায় বেরিয়ে রিকশায় উঠে স্থান ত্যাগ করে। পুলিশ সূত্র জানায়, মেয়েটি খুব ঠান্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বাথরুমে গিয়ে গোসল করে নিজের শরীরের সমস্ত রক্ত পরিষ্কার করে নাফিসার স্কুলের ড্রেস পরে বেরিয়ে যায়।
ঘটনাস্থলের আলামত ও হত্যার উদ্দেশ্য
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশ ও গোয়েন্দা দল কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামত উদ্ধার করেছে, যা হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়েছে। বাসার ভেতরে ধস্তাধস্তির স্পষ্ট আলামত রয়েছে। মেঝে এবং দেয়ালজুড়ে রক্তের দাগ ছিল। আলমারি ও ভ্যানিটি ব্যাগ তছনছ করা হয়েছে। তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, চুরির উদ্দেশ্যেই এমনটা হতে পারে।”
হত্যার অস্ত্র: হত্যায় ব্যবহৃত দুটি ধারালো ছুরি বাথরুমের বালতির ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
ছুরির ব্যবহার এবং চুরির আলামত ইঙ্গিত দেয়, হয়তো গৃহকর্মী চুরির চেষ্টা করছিল এবং মা ও মেয়ে তা দেখে ফেলায় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে।
পুলিশের তদন্তের কৌশল
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইবনে মিজান জানিয়েছেন, গৃহকর্মীই যে সন্দেহভাজন, এই বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে। পুলিশ তাঁর আসল নাম, আগের পরিচয়, ও অতীতের কর্মকাণ্ড—সবই তদন্তে দেখছে।
- গতিবিধি বিশ্লেষণ: হত্যার আগের এবং পরের তার গতিবিধি বিশ্লেষণ করে তদন্ত এগিয়ে চলবে।
- সুরতহাল: নিহত মা ও মেয়ের লাশ সুরতহাল শেষে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।
গৃহকর্মী নিয়োগে সতর্কতা ও নিরাপত্তা ইস্যু
এই জোড়া হত্যাকাণ্ড আবারও গৃহকর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এনেছে। গৃহকর্তা আজিজুল ইসলাম জানান, মেয়েটি চার দিন আগে কাজের খোঁজে এসেছিল এবং তাঁর স্ত্রী তার সঙ্গে কথা বলে কাজে রেখে দেন।
- নিয়োগের প্রক্রিয়া: গৃহকর্মীর পরিচয়, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং স্থায়ী ঠিকানা যাচাই না করেই কাজে রাখলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
- সন্দেহের কারণ: গৃহকর্তা জানান, মেয়েটি বোরকা পরিহিত ছিল এবং তাঁর শরীরে আগুনে পোড়ার দাগ ছিল—এই বিষয়গুলোই তাঁর অতীত সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি করে।
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, গৃহকর্মী নিয়োগের আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নিশ্চিত করা কতটা জরুরি।
নিরাপত্তার প্রশ্ন ও বিচারের দাবি
মোহাম্মদপুরের আবাসিক ফ্ল্যাটে মা ও মেয়েকে গৃহকর্মীর হাতে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাটি দেশের শহরাঞ্চলের মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্নে এক বড় আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। চুরির উদ্দেশ্যে এই জোড়া হত্যাকাণ্ড ঘটলেও, গৃহকর্মীর ঠান্ডা মাথায় স্কুলড্রেস পরে পালিয়ে যাওয়ার কৌশল প্রমাণ করে যে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আরও গভীর কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে। পুলিশকে দ্রুত পলাতক গৃহকর্মী আয়েশাকে গ্রেপ্তার করে এই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করতে হবে এবং দোষীকে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এম আর এম – ২৫৪৯, Signalbd.com



