ঝিনাইদহের সদর উপজেলার বেতাই গ্রামে ছোট ভাইয়ের বটির আঘাতে বড় ভাই নিহত হয়েছেন। রবিবার (৭ ডিসেম্বর) দুপুরে পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। স্থানীয় পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এই বিরোধের মূল কারণ ছিল ছোট ভাইয়ের প্রবাস থেকে পাঠানো টাকার হিসাব। নিহত বড় ভাইয়ের নাম সোহেল রানা, আর অভিযুক্ত ছোট ভাই হলেন সাব্বির আহম্মেদ জুয়েল, যিনি দুই মাস আগে বিদেশ থেকে দেশে ফেরেন। গুরুতর আহত অবস্থায় সোহেল রানাকে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান। ঘটনার পর অভিযুক্ত ছোট ভাই জুয়েল পলাতক রয়েছেন এবং পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিস্তারিত: টাকার হিসাব নিয়ে পারিবারিক বিরোধ
বেতাই গ্রামের শফি উদ্দিনের দুই ছেলে সোহেল রানা এবং সাব্বির আহম্মেদ জুয়েল। তাঁদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক কলহ চলছিল, যার প্রধান কারণ ছিল ছোট ভাইয়ের প্রবাস থেকে পাঠানো টাকা।
বিবাদের সূত্রপাত: সাব্বির আহম্মেদ জুয়েল দীর্ঘদিন প্রবাসে (বিদেশে) থেকে নিয়মিত বড় ভাই সোহেল রানার কাছে টাকা পাঠাতেন। দুই মাস আগে জুয়েল দেশে ফিরে এসে বড় ভাইয়ের কাছে টাকার হিসাব চাইলে তাঁদের মধ্যে তীব্র বিরোধ সৃষ্টি হয়।
আলাদা বসবাস: বিরোধের জেরে দুই ভাই আলাদা হয়ে বসবাস করতে শুরু করেন।
হামলার কারণ: রবিবার দুপুরবেলা বাড়িতে রান্নার জ্বালানি ব্যবহারে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে এই বিবাদ চরম আকার ধারণ করে।
হত্যাকাণ্ড: জুয়েল ক্ষিপ্ত হয়ে বটি দিয়ে বড় ভাই সোহেল রানার ঘাড়ে আঘাত করেন। গুরুতর আহত অবস্থায় সোহেলকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তিনি মারা যান।
পুলিশের ধারণা, টাকার হিসাব নিয়ে দীর্ঘদিনের চাপা ক্ষোভ রান্নার জ্বালানি ব্যবহারের মতো ছোট ঘটনায় প্রকাশ পায় এবং তা হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়ায়।
পুলিশি তৎপরতা ও আইনগত ব্যবস্থা
ঘটনার পর পরই ঝিনাইদহ সদর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং পরবর্তী আইনি প্রক্রিয়া শুরু করে।
পুলিশের বক্তব্য: ঝিনাইদহ সদর থানার ওসি (তদন্ত) জহিরুল ইসলাম বলেন, “খবর পাওয়ার পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। মরদেহ উদ্ধার করে সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হবে।”
গ্রেপ্তারের চেষ্টা: ঘটনার পর অভিযুক্ত ছোট ভাই জুয়েল পলাতক রয়েছেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
মামলার প্রস্তুতি: ওসি জানান, এ ঘটনায় নিহত সোহেল রানার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ দায়েরের পর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রবাসী আয় ও পরিবারের প্রতিদান
এই ঘটনা বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে প্রবাসী আয়ের হিসাব ও ব্যবস্থাপনার মতো স্পর্শকাতর বিষয়কে সামনে এনেছে। প্রবাসীরা বিদেশে কঠিন পরিশ্রম করে টাকা পাঠালেও, দেশে পরিবারের সদস্যদের কাছে সেই টাকার সঠিক ব্যবহার বা হিসাব না পাওয়ায় অনেক সময়ই এমন পারিবারিক সংঘাত তৈরি হয়।
- আর্থিক বঞ্চনা: ছোট ভাই জুয়েল প্রবাসে থেকে তাঁর কষ্টের উপার্জিত টাকা বড় ভাইয়ের কাছে ভরসা করে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দেশে ফিরে সেই টাকার হিসাব না পাওয়ায় তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন।
- আস্থার সংকট: এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, অনেক প্রবাসীই তাঁদের পাঠানো টাকার হিসাব নিয়ে পরিবারে আস্থার সংকটে ভোগেন। এই আস্থার সংকটই অনেক সময় এমন ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়।
গ্রামীণ সমাজে সহিংসতা ও পারিবারিক বন্ধন
প্রবাসী আয়ের হিসাব নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যেকার এই হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে পারিবারিক বন্ধনের দুর্বলতা এবং সহিংসতার প্রবণতা বৃদ্ধিকে তুলে ধরেছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বেতাই গ্রামের মানুষ এই ঘটনায় হতবাক। আর্থিক লেনদেন নিয়ে সৃষ্ট পারিবারিক বিরোধে একজনের জীবন চলে যাওয়া সমাজে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত দেয়। এমন ঘটনা পারিবারিক মূল্যবোধ এবং সম্পর্ককে দুর্বল করে দেয়।
পারিবারিক সংঘাতের ভয়াবহ পরিণতি
ঝিনাইদহের বেতাই গ্রামে প্রবাসী আয়ের হিসাব নিয়ে ছোট ভাইয়ের বটির আঘাতে বড় ভাইয়ের নিহত হওয়ার ঘটনাটি পারিবারিক সংঘাতের এক ভয়াবহ পরিণতি। এই হত্যাকাণ্ড কেবল একটি পরিবারের ট্র্যাজেডি নয়, বরং প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থের হিসাব নিয়ে দেশের গ্রামীণ সমাজগুলোতে যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করে, তারই বহিঃপ্রকাশ। অভিযুক্ত জুয়েলকে দ্রুত গ্রেপ্তার এবং ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে এই ধরনের পারিবারিক বিয়োগান্তক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।
এম আর এম – ২৫৩৫, Signalbd.com



