ফরিদপুরে খেজুর ও আখের গুড়ের নামে চলছিল ভয়াবহ ভেজাল বাণিজ্য। গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত নিম্নমানের চিটাগুড়, নিষিদ্ধ হাইড্রোজ, এবং জুতার সোল তৈরির কেমিক্যালের মতো ক্ষতিকর উপাদান মিশিয়ে তৈরি হচ্ছিল ভেজাল গুড়। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ফরিদপুর সদর উপজেলার শিবরামপুর এলাকায় একটি ভেজাল গুড় তৈরির কারখানায় জেলা প্রশাসন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। অভিযানে কারখানাটি থেকে সাড়ে ৬ হাজার কেজি ভেজাল গুড় এবং শিল্প-কারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক জব্দ করে জনসম্মুখে ধ্বংস করা হয়। এই ঘটনাটি খাদ্য নিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। কারখানাটি সিলগালা করে মালিকের বিরুদ্ধে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ভেজাল গুড় তৈরির উপাদান: গো-খাদ্য ও নিষিদ্ধ কেমিক্যাল
ফরিদপুর জেলা শহরতলীর শিবরামপুরের ছোট বটতলা এলাকায় স্বপন কুমার শীলের মালিকানাধীন কারখানায় এই ভেজাল গুড় তৈরি হচ্ছিল। নিরাপদ খাদ্য অফিসার মো. আজমুল ফুয়াদ জানান, কারখানাটি অত্যন্ত নোংরা, স্যাঁতস্যাঁতে এবং অপরিষ্কার পরিবেশে পরিচালিত হচ্ছিল। ভেজাল গুড় তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানগুলো ছিল মারাত্মক ক্ষতিকর:
- নিম্নমানের চিটাগুড়: ভারত থেকে আমদানিকৃত নিম্নমানের টিনজাত চিটাগুড় ব্যবহার করা হতো, যা মূলত গো-খাদ্যে (গরুর খাদ্য) ব্যবহৃত হয়।
- ক্ষতিকর রাসায়নিক: এর সঙ্গে মেশানো হতো নিষিদ্ধ হাইড্রোজ (যা গুড়কে সাদা করে), ফিটকিরি, ক্ষতিকর নন-ফুড গ্রেড রং ও ফ্লেভার, পচা মিষ্টি, নষ্ট মিষ্টির গাদ, ময়দা, সোডা ও চিনি।
- ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল: কারখানায় আরও পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল কেমিক্যাল, যেমন D–9700 (রেজিন/সলভেন্ট/আঠা জাতীয় উপাদান) এবং জুতার সোল তৈরির কেমিক্যাল। এই ধরনের কেমিক্যাল খাদ্যপণ্য তৈরিতে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
এই ধরনের উপাদান মিশিয়ে খেজুর ও আখের গুড় তৈরি করা ছিল মানুষের জীবন নিয়ে এক জঘন্য খেলা।
মোবাইল কোর্টের অভিযান ও জব্দ সামগ্রী
জেলা প্রশাসন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে একটি যৌথ মোবাইল কোর্ট এই অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন ফরিদপুর জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. আতিকুর রহমান। অভিযানে ফরিদপুরের নিরাপদ খাদ্য অফিসার মো. আজমুল ফুয়াদ সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন এবং বাংলাদেশ আনসারের একটি চৌকস দল অভিযানে সহযোগিতা করে।
অভিযানের সময় কারখানায় মালিক পক্ষের কেউ উপস্থিত ছিল না। অভিযান শেষে সাড়ে ৬ হাজার কেজি ভেজাল গুড় এবং শিল্পে ব্যবহার্য ক্ষতিকর কেমিক্যাল জব্দ করে জনসম্মুখে ধ্বংস করা হয়। এই ধরনের ধ্বংসাত্মক ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে প্রশাসন এই ভেজাল বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর বার্তা দিল।
মামলা দায়ের ও কারখানা সিলগালা
ভেজাল গুড় তৈরির অপরাধে কারখানাটি সিলগালা করা হয়েছে। এছাড়াও, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সহকারী কমিশনার মো. আতিকুর রহমান জানান, নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩-এর আওতায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
কারখানার রেজিস্টার ও নথিপত্র পর্যালোচনা করে নিরাপদ খাদ্য অফিসার মো. আজমুল ফুয়াদ জানান, এই কারখানাটি মূলত রাতের অন্ধকারে ভেজাল গুড় উৎপাদন করে শুধু ফরিদপুরেই নয়, বরং ঢাকা ও রাজশাহীর মতো দেশের বড় বড় বাজারেও সরবরাহ করত। রাতের অন্ধকারে এই চক্রটি সক্রিয় থাকায় তাদের শনাক্ত করা কঠিন ছিল।
জনস্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব
গো-খাদ্যের চিটাগুড় এবং জুতার সোল তৈরির কেমিক্যাল মিশ্রিত গুড় মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। নিষিদ্ধ হাইড্রোজ এবং নন-ফুড গ্রেড রং দীর্ঘমেয়াদে লিভার, কিডনি এবং পরিপাকতন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। এসব ক্ষতিকর রাসায়নিক মানবদেহে প্রবেশ করলে ক্যান্সারের মতো প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকিও বাড়ে।
বিশেষ করে, গুড় যেহেতু শিশু থেকে বয়স্ক সবার কাছেই জনপ্রিয় একটি মিষ্টি খাবার, তাই এই ভেজাল গুড় বাজারজাত হওয়ার ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। এই ঘটনা প্রমাণ করে, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী শুধুমাত্র মুনাফার লোভে মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
ভেজাল বাণিজ্য প্রতিরোধের চ্যালেঞ্জ
খাদ্য ভেজাল প্রতিরোধে সরকারের প্রচেষ্টা থাকলেও, অসাধু ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন কৌশল ব্যবহার করে তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের ভেজাল বাণিজ্য প্রতিরোধের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো:
১. গোপনীয়তা: ভেজাল গুড় তৈরির কারখানাগুলো সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে বা রাতের অন্ধকারে পরিচালিত হয়। ২. আইনের দুর্বল প্রয়োগ: বিদ্যমান আইন থাকলেও অনেক সময় প্রভাবশালীদের কারণে এর প্রয়োগ দুর্বল হয়ে যায়। ৩. সচেতনতার অভাব: সাধারণ জনগণ অনেক সময় ভেজাল গুড় চিনতে পারে না এবং দাম কম হওয়ায় এর প্রতি আকৃষ্ট হয়।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মোবাইল কোর্টের অভিযানকে আরও জোরদার করতে হবে এবং ভেজালকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ভেজালের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান জরুরি
ফরিদপুরের ভেজাল গুড় তৈরির কারখানায় অভিযান এবং সাড়ে ৬ হাজার কেজি গুড় ধ্বংসের ঘটনাটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে জনগণের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। গো-খাদ্য ও জুতার কেমিক্যাল ব্যবহার করে গুড় তৈরির এই জঘন্য অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোরতম অবস্থান নেওয়া এখন সময়ের দাবি। জেলা প্রশাসন ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এই ধরনের ভেজাল চক্রের মূল হোতাদের চিহ্নিত করে বিশুদ্ধ খাদ্য আইন, ২০১৩ অনুযায়ী কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারকে খাদ্য ভেজালের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অটল থাকতে হবে।
এম আর এম – ২৪৭২, Signalbd.com



