আঞ্চলিক

ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৫৬৫: চলতি বছরে মৃত্যু ৩৮৬

Advertisement

দেশে এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক মাত্রায় বজায় রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে আরও ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৫ জন। মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়। নতুন মৃত্যু নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৮৬ জনে। বছরের শেষ প্রান্তিকে এসেও ডেঙ্গু পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ না হওয়ায় দেশের জনস্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে।

২৪ ঘণ্টার পরিসংখ্যান: মৃত্যু ও রোগী ভর্তির চিত্র

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত (২৪ ঘণ্টায়) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ২ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। এই সময়ে নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৫৬৫ জন। এই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, শীতকাল ঘনিয়ে আসলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না।

গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ৫৭৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এই রোগীদের সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ায় কিছুটা স্বস্তি মিললেও, দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ৫৫০-এর ওপরে থাকা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের জন্য উদ্বেগের কারণ। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ারা যোগ হয়ে চলতি বছরে মোট ছাড়পত্র পাওয়া রোগীর সংখ্যা এখন ৯৩ হাজার ১৯৬ জন

বিভাগভিত্তিক সংক্রমণ: ঢাকা ও চট্টগ্রামে রোগীর চাপ

গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৫৬৫ জন রোগীর মধ্যে দেশের বিভিন্ন বিভাগে সংক্রমণের চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো:

বিভাগনতুন রোগী সংখ্যা
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন১২৭ জন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন৮৮ জন
ঢাকা বিভাগ (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে)৯৫ জন
চট্টগ্রাম বিভাগ৮২ জন
বরিশাল বিভাগ৫১ জন
ময়মনসিংহ বিভাগ৪৫ জন
খুলনা বিভাগ (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে)৪৩ জন
রাজশাহী বিভাগ৩০ জন
রংপুর বিভাগ৩ জন
সিলেট বিভাগ১ জন

এই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নতুন রোগী ভর্তির সংখ্যা এখনও সর্বোচ্চ (১২৭ জন)। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বাইরের এলাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগেও রোগীর চাপ উল্লেখযোগ্য (যথাক্রমে ৯৫ জন ও ৮২ জন)। এই তথ্য প্রমাণ করে ডেঙ্গু সংক্রমণ কেবল রাজধানীতে নয়, বরং সারাদেশের বিভাগীয় শহর ও অন্যান্য অঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে।

চলতি বছরের সামগ্রিক চিত্র ও পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বিশ্লেষণ

চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতির সামগ্রিক চিত্র জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৯৫ হাজার ৫৭৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মোট মৃতের সংখ্যা ৩৮৬ জনে পৌঁছেছে।

তুলনামূলকভাবে, গত বছরগুলোতে ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহতা ছিল আরও বেশি:

  • ২০২৪ সাল: জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মোট মৃত্যু হয় ৫৭৫ জনের
  • ২০২৩ সাল: ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হন মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মোট মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের

যদিও গত দুই বছরের তুলনায় চলতি বছরের আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কম, তবে বছরের শেষ প্রান্তিকে সংক্রমণ অব্যাহত থাকা উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ডেঙ্গুর মৌসুম পরিবর্তন এবং এডিস মশার টিকে থাকার সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

সংক্রমণ না কমার কারণ: বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু সংক্রমণ না কমার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন:

১. মৌসুম পরিবর্তন: ডেঙ্গু এখন আর বর্ষা বা বর্ষা-পরবর্তী রোগ নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার তারতম্য এডিস মশার জীবনচক্রকে প্রভাবিত করছে, ফলে এটি বছরের অধিকাংশ সময় ধরে সক্রিয় থাকছে।

২. অপর্যাপ্ত মশা নিয়ন্ত্রণ: সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে বছরব্যাপী কার্যকর মশা নিধন কর্মসূচির অভাব রয়েছে। কেবল লার্ভা নিধন নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ মশা নিয়ন্ত্রণেও আধুনিক ও কার্যকরী পদক্ষেপের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

৩. নগরায়ণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমা এবং দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র বাড়ছে।

৪. সেরোটাইপ পরিবর্তন: ডেঙ্গুর ভাইরাসের (সেরোটাইপ) পরিবর্তনের কারণেও রোগটি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে এবং দ্বিতীয়বার আক্রান্তদের ক্ষেত্রে মারাত্মক ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের ঝুঁকি বাড়ছে।

চিকিৎসা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

ডেঙ্গু রোগীদের নিয়মিত ভর্তির কারণে দেশের হাসপাতালগুলোর ওপর চাপ অব্যাহত রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় হাসপাতালেই ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলোতে ভিড় বাড়ছে। এই সময়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো:

  • প্লেটলেট ও স্যালাইনের সরবরাহ: ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় স্যালাইন এবং গুরুতর রোগীদের জন্য রক্তের প্লেটলেট যেন পর্যাপ্ত থাকে, তা নিশ্চিত করা।
  • মানসম্মত চিকিৎসা: ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার এবং শক সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা (ICU) নিশ্চিত করা।
  • সচেতনতা: জ্বর হলে দ্রুত ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর সঙ্গে আরও কঠোর সমন্বয় এবং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনার ওপর জোর দিতে হবে।

ডেঙ্গু মোকাবিলায় জাতীয় উদ্যোগ জরুরি

ডেঙ্গুতে দৈনিক ২ জনের মৃত্যু এবং ৫৬৫ জন নতুন রোগীর ভর্তি প্রমাণ করে যে, এই রোগটি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী হুমকি। কেবল স্বাস্থ্যখাত নয়, বরং স্থানীয় সরকার, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। ডেঙ্গু মোকাবিলাকে একটি জাতীয় জরুরি কাজ হিসেবে বিবেচনা করে সারা বছর ধরে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি।

এম আর এম – ২৪৫৬,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button