ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং ধর্ম অবমাননার গুরুতর অভিযোগে বাউল শিল্পী আবুল সরকারের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দিয়েছেন। সোমবার (১ ডিসেম্বর) ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আরিফুল ইসলাম এই নির্দেশ দেন। মামলায় বাউল শিল্পী আবুল সরকারকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মহান আল্লাহ্ তায়ালা এবং পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের সুরা আন-নাস সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন, যা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
মামলার বাদী ও আদালতের নির্দেশ
বাউল আবুল সরকারের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের নিউরোট্রমা সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান। বাদীপক্ষের আইনজীবী সোলাইমান তুষার সাংবাদিকদের এই আইনি পদক্ষেপের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মামলাটি আমলে নিয়ে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক আরিফুল ইসলাম রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) ঘটনাটির সঠিক তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্তে যদি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, তবে আদালতের পরবর্তী নির্দেশনায় আবুল সরকারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা অন্য কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে।
ধর্ম অবমাননার অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, বাউল শিল্পী আবুল সরকার চলতি বছরের ৪ নভেম্বর বা তার কাছাকাছি কোনো এক অজ্ঞাত তারিখে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরাখালা পাগলির মেলামঞ্চে দেওয়া তাঁর বক্তব্য বা গান এবং পরে অনলাইনে প্রকাশিত ভিডিওতে ধর্ম অবমাননাকর মন্তব্য করেন।
আবুল সরকার তাঁর বক্তব্য বা গানে মহান আল্লাহ্ তায়ালা এবং পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের শেষ সুরাগুলোর অন্যতম সুরা আন-নাস সম্পর্কে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অবমাননাকর মন্তব্য করেন। বাদীর অভিযোগ, আসামির এই বক্তব্য ও আচরণ ইচ্ছাকৃতভাবে মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করেছে, যা জনমনে তীব্র উত্তেজনা ও ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তাঁর বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
যে ধারায় মামলা: ২৯৫ এবং ২৯৫ (ক)
আবুল সরকারের বিরুদ্ধে মামলাটি দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (Penal Code, 1860)-এর ২৯৫ এবং ২৯৫ (ক) ধারায় করা হয়েছে। এই দুটি ধারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত অপরাধের সাথে সম্পর্কিত:
- দণ্ডবিধি ২৯৫ ধারা: কোনো ধর্মকে অবমাননা করার উদ্দেশ্যে উপাসনালয় বা পবিত্র স্থানে ক্ষতি সাধন করা বা তাকে অপবিত্র করা।
- দণ্ডবিধি ২৯৫ (ক) ধারা: ইচ্ছাকৃতভাবে ও বিদ্বেষপূর্ণভাবে কোনো শ্রেণীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার উদ্দেশ্যে শব্দ ব্যবহার করা বা দৃশ্যমান কিছু তৈরি করা। এই ধারায় অভিযুক্তের শাস্তি দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে।
এই ধারায় মামলা দায়ের হওয়ায় এর আইনি গুরুত্ব অনেক বেশি এবং এই অভিযোগ প্রমাণিত হলে আবুল সরকার কঠোর শাস্তির সম্মুখীন হতে পারেন।
আবুল সরকারের পূর্ববর্তী অবস্থান ও রাজনৈতিক পটভূমি
বাউল শিল্পী আবুল সরকার তাঁর গানের মাধ্যমে দীর্ঘকাল ধরে বাংলার লোক সংস্কৃতিতে পরিচিত মুখ। তবে তাঁর কিছু গান ও বক্তব্য প্রায়শই বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ নতুন নয়। তাঁর গানের একটি বিশেষ ধারা রয়েছে, যা অনেক সময় মূল ধারার ইসলামি চিন্তাধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
এই মামলাটি এমন এক সময়ে হলো, যখন দেশে সরকারের পট পরিবর্তন হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, অতীতের সরকারগুলোর সময়ে আবুল সরকার রাজনৈতিক মদদ পেয়েছিলেন। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও দাবি করা হয়েছিল, বাউল আবুল সরকার পলাতক আওয়ামী লীগের দোসর, এবং তাঁর শাস্তির দাবি জানানো হয়েছিল। এই রাজনৈতিক সংযোগের অভিযোগগুলো মামলার গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও বাউল শিল্পীদের নিরাপত্তা
আবুল সরকারের বক্তব্য অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেছে। তবে অন্যদিকে, কিছু মহল বাউলদের ওপর হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়ারও দাবি জানিয়েছে। এই পরিস্থিতি দেশের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করার চ্যালেঞ্জকে সামনে এনেছে।
বাউল শিল্পীরা প্রায়শই রক্ষণশীল ধর্মীয় গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়ে থাকেন। তবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠলে তা আইনি প্রক্রিয়ায় সমাধান হওয়া প্রয়োজন। এই মামলাটি দেশের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার সীমা নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির সৃষ্টি করতে পারে।
তদন্তের দিকে সবার নজর
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে বাউল শিল্পী আবুল সরকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের এবং আদালতের নির্দেশে রমনা থানার ওসির তদন্ত শুরু—এই ঘটনা দেশের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। দণ্ডবিধি ২৯৫ ও ২৯৫ (ক) ধারায় দায়ের হওয়া এই মামলাটির আইনি গুরুত্ব অপরিসীম। মামলার বাদী ও অভিযুক্ত উভয়ের বক্তব্য এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ তদন্তের মাধ্যমে যাচাই করা হবে। রমনা থানার ওসি নির্ধারিত সময়ে আদালতে কী প্রতিবেদন দাখিল করেন এবং আদালত এরপর কী সিদ্ধান্ত নেন, সেদিকেই সবার নজর থাকবে। আবুল সরকারের মতো জনপ্রিয় শিল্পীর বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ দেশের সমাজে একটি কঠোর বার্তা দেবে এবং আইনের শাসনের গুরুত্বকে তুলে ধরবে।
এম আর এম – ২৪৫০,Signalbd.com



