আঞ্চলিক

 ফাইভ পাস আবুল বয়াতি এখন কোরআনের তাফসিরকারক!

Advertisement

বিতর্কিত বাউলশিল্পী আবুল সরকার মহারাজ ওরফে আবুল বয়াতি মাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়েই ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে অপব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছিলেন। শুধু পঞ্চম শ্রেণি পাস করেও গত পাঁচ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন আসরে নিজেকে পবিত্র কোরআনের ‘তাফসিরকারক’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। এসব বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য এবং ধর্মীয় আয়াত নিয়ে ভুয়া বিবরণ তিনি ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার করতেন। সম্প্রতি মানিকগঞ্জের ঘিওরের একটি পালাগানের আসরে আল্লাহ, কোরআন ও নবী মুহম্মদ (সা.)-সহ কয়েকটি স্পর্শকাতর ধর্মীয় বিষয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ ওঠার পর দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অবশেষে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় বর্তমানে কারাগারে আছেন আবুল বয়াতি। তারেকুল ইসলাম মানিকগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) গত ২০ নভেম্বর মাদারীপুর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। জামিন শুনানিতে আদালত তার জামিন আবেদন দুই দফায় নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তার এই বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও রহস্যময় জীবনযাপন নিয়ে ইতোমধ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসতে শুরু করেছে।

বিতর্কের মূল কারণ ও আইনি পদক্ষেপ

কীভাবে আবুল বয়াতির ধর্মীয় অপব্যাখ্যা বিতর্কের সৃষ্টি করল এবং পুলিশ কীভাবে তাকে গ্রেপ্তার করল।

ধর্মীয় কটূক্তি: গত ৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওরের জাবরা এলাকায় একটি পালাগানের অনুষ্ঠানে ইসলাম ধর্ম, আল্লাহ ও নবীকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ও আপত্তিকর বক্তব্য দেন আবুল বয়াতি। তার এই বক্তব্য দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

প্রচারমাধ্যম: তিনি নিজেই তার এসব বিভ্রান্তিমূলক তাফসির ও বক্তব্য ইউটিউব ও ফেসবুকে প্রচার করতেন, যা তাকে দ্রুত বিতর্কিত করে তোলে।

গ্রেপ্তার ও মামলা: ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। মাদারীপুর থেকে গ্রেপ্তার করার পর আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করায় তিনি এখন কারাগারে।

তদন্তের গতিপথ: পুলিশ এই বিতর্কমূলক কর্মকাণ্ডের পিছনে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির কোনো ষড়যন্ত্র ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখছে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ইতোমধ্যে তার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

রহস্যময় জীবনযাপন ও পীর দাবি

আবুল বয়াতির জীবনযাপন, তার রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা এবং নিজেকে নতুন করে পীর হিসেবে দাবি করার চেষ্টা।

ভিআইপি ভক্তের আনাগোনা: মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার চর দিল্লি গ্রামে তার বাড়িতে ভিআইপি ভক্তদের নিয়মিত আনাগোনা ছিল এবং সেখানে নানা ধরনের আসর বসত। এসব আড্ডায় তিনি প্রায়ই ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করতেন।

রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা: সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট গোলাম মহিউদ্দিনের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় এতোদিন কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেত না বলে অভিযোগ রয়েছে। তার সরাসরি কোনো দলীয় পদ-পদবি না থাকলেও এই রাজনৈতিক প্রভাব তাকে সুরক্ষা দিত।

নতুন পীর হওয়ার চেষ্টা: আবুল বয়াতি নিজেকে পীর হিসেবে পরিচিত করতে শুরু করেছিলেন। তিনি দাবি করতেন, ২০০৭ সালে পীর সৈয়দ হাসিব আল হাসান রেজুইয়ের কাছ থেকে তিনি ‘খেলাফত’ পেয়েছেন। অতিরিক্ত টাকা আয়ের জন্যই তিনি নতুন পীর হওয়ার চেষ্টা করছিলেন বলেও পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন।

নতুন নাম ধারণ: পীর দাবির পর তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘সৈয়দে গোলাম মহারাজ আবুল সরকার আল চিশতী নিজামি’ লেখেন।

পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও সম্পত্তির দখল

আবুল বয়াতির সঙ্গে তার আপন ছোট ভাইয়ের দীর্ঘদিনের বিরোধ এবং হয়রানির অভিযোগ।

আবুল বয়াতির ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম একটি মসজিদের ইমাম। ধর্ম নিয়ে আবুলের অপব্যাখ্যা দেওয়ার কারণে দুই ভাইয়ের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। ছোট ভাই জাহাঙ্গীর অভিযোগ করেছেন, আবুল বয়াতি তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে জাহাঙ্গীরকে জমিসংক্রান্ত বিরোধে হয়রানি করেছেন। তিনি জাহাঙ্গীরকে জামায়াত ও শিবিরের তকমা দিয়ে একাধিক মামলায় জড়িয়ে জেলেও পাঠিয়েছেন

জাহাঙ্গীরের বাড়িতে একটি মহিলা মাদরাসা ছিল, যা আবুল তার রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসন ব্যবহার করে বন্ধ করে দেন

জমি দখল: আবুল তার পৈতৃক সম্পত্তির ৬১ শতাংশের মধ্যে ভাইবোনদের ঠকিয়ে একাই ৪৫ শতাংশ জায়গা গোপনে লিখে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আরও অভিযোগ করেন, আবুল তার বাড়ির সামনে ৪ শতাংশ জমি দখল করেছেন, যা নিয়ে এখনও মামলা চলছে।

বাউল জীবন ও ভক্তকুল

আবুল বয়াতির বাউল শিল্পী হিসেবে পরিচিতি এবং তার ভক্ত ও শিষ্যের সংখ্যা।

বাউল যাত্রা: দুই সন্তানের জনক আবুল বয়াতি মাত্র ১০ বছর বয়স থেকেই বাউল গান গাওয়া শুরু করেন। তার স্ত্রী আলেয়া বেগমও একজন বাউলশিল্পী এবং তিনি সব আসরেই তার সঙ্গে যেতেন।

অনুসারী ও শিষ্য: তিনি ঢাকাসহ সারা দেশে প্রায় ৫০ হাজারের মতো ভক্ত এবং প্রায় এক হাজার শিষ্য থাকার দাবি করতেন।

বিদেশ ভ্রমণ: তিনি একাধিকবার ভারতে গেছেন এবং ভক্তদের কাছে আজমির শরিফ ভ্রমণের দাবি করেছেন। তিনি ২০০৭ সালে তার গানের ওস্তাদ রশিদ সরকারের সঙ্গে ওমরা হজও পালন করেছেন।

শারীরিক অসুস্থতা: ২০১৯ সালে জমি দখলের ঘটনার পর থেকে তার গায়ে প্রচণ্ড চুলকানি শুরু হয়, যা চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গিয়েও ভালো হয়নি। এই রোগের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে তিনি এখন প্রায়শই কাফনের মতো সাদা কাপড় পরিধান করে থাকেন।

ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক (কোট): “আবুল বয়াতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো আছে।”

ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহার

আবুল বয়াতির মতো বিতর্কিত ব্যক্তির কার্যকলাপ সমাজে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

  • ধর্মীয় বিভ্রান্তি: মাত্র পঞ্চম শ্রেণি পাস করে কোরআনের তাফসিরকারক দাবি করা এবং ধর্ম নিয়ে অপব্যাখ্যা দেওয়া সমাজে ধর্মীয় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এর মাধ্যমে সহজ-সরল মানুষ ভুল পথে পরিচালিত হতে পারে।
  • ক্ষমতার অপব্যবহার: রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে আপন ভাইয়ের ওপর হয়রানি ও জমি দখল করার অভিযোগটি ক্ষমতার চরম অপব্যবহারের নজির। এটি সমাজের সাধারণ মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
  • বাউলশিল্পীর মানহানি: আবুল বয়াতির বিতর্কিত কর্মকাণ্ড বাউলশিল্পের ঐতিহ্যবাহী মর্যাদা ও সম্মানকেও ক্ষুণ্ণ করেছে। তার অপকর্মের জন্য অনেক প্রকৃত বাউলশিল্পীকেও সমালোচিত হতে হচ্ছে।
  • বাউলদের ওপর হামলা: এই ঘটনার পর কারাবন্দি আবুল বয়াতির মুক্তির দাবিতে মানিকগঞ্জে মানববন্ধনে যোগ দিতে আসা বাউলদের ওপর হামলার অভিযোগে ২০০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। এটি দেখায়, এই বিতর্কের প্রভাব সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে।

দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবি

বিতর্কিত বাউলশিল্পী আবুল বয়াতির ধর্মীয় কটূক্তি ও প্রতারণার ঘটনাটি সমাজে এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার পাশাপাশি তিনি তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পারিবারিক ও সম্পত্তির বিরোধেও জড়িয়েছেন। তার এই কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে যে, তিনি ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়াই অতিরিক্ত অর্থ এবং খ্যাতি অর্জনের জন্য নিজেকে ‘পীর’ ও ‘তাফসিরকারক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত, তার বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ, বিশেষ করে তার ভাইয়ের ওপর চালানো হয়রানি এবং জমি দখলের বিষয়গুলো নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা। ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী এবং ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে কেউ ধর্মকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত ফায়দা লোটার সাহস না পায়।

এম আর এম – ২৩৮৫,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button