আঞ্চলিক

‘আগুনে সব শ্যাষ, এই শীতের রাতে থাকমু কই’

Advertisement

রাজধানীর মহাখালী সংলগ্ন কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর এখন চলছে স্বজন ও সম্পদ হারানোর হৃদয়বিদারক আহাজারি। মঙ্গলবার বিকেলে লাগা আগুন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চেষ্টার পর ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও ততক্ষণে পাঁচ শতাধিক ঘর পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বলে বস্তিবাসীর দাবি। সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মানুষের চোখে এখন শুধুই শূন্যতা আর সামনে শীতের রাতের অনিশ্চিত আতঙ্ক। রিকশাচালক লুৎফর রহমান তার পুড়ে যাওয়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন

“আগুনে সব শ্যাষ, এই শীতের রাতে থাকমু কই।”

বস্তির বাসিন্দারা বলছেন, ঘরগুলো টিন, বাঁশ ও কাঠের তৈরি হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ বাসিন্দা দিনমজুর, রিকশাচালক বা পোশাককর্মী হওয়ায় বিকেলে তারা ঘরে ছিলেন না। আগুনের খবর শুনে এসে তারা দেখেন, তাদের জীবনের শেষ সম্বলটুকু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখনও কোনো হতাহতের খবর না এলেও, হাজার হাজার মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। অগ্নিকাণ্ডের ফলে বস্তি এলাকা বিদ্যুৎহীন রয়েছে এবং চারপাশে কেবল ধ্বংসস্তূপ আর পোড়া গন্ধ।

অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা ও নিয়ন্ত্রণের চিত্র

কখন আগুন শুরু হলো, নিয়ন্ত্রণে কতক্ষণ লাগলো এবং কী কী কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে হয়েছে।

সময়কাল ও ইউনিটের তৎপরতা: মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। শুরুতে ১৭টি ইউনিট কাজ শুরু করলেও পরবর্তীতে ইউনিট সংখ্যা বেড়ে ২০টিতে দাঁড়ায়। প্রায় ৫ ঘণ্টা চেষ্টার পর রাত সাড়ে ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

নিয়ন্ত্রণের বাধা: ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান, যানজটের কারণে প্রথমে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে দেরি হয়। এছাড়া, বস্তির ভেতরের সরু গলি এবং পানির তীব্র অভাব আগুন নিয়ন্ত্রণে প্রধান বাধা সৃষ্টি করে। ফায়ার ফাইটাররা কড়াইল ঝিলে পাম্প বসিয়ে এবং ওয়াসার গাড়ি দিয়ে পানি সরবরাহ করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন।

সামরিক ও স্বেচ্ছাসেবক সহায়তা: পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন। সড়কে শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি রেড ক্রিসেন্ট ও শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন।

বস্তিবাসীর কষ্টের চিত্র: সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব

অগ্নিকাণ্ডের ফলে বস্তির নিম্ন আয়ের মানুষের জীবন ও জীবিকার যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

লুৎফর-আসমা দম্পতির হাহাকার: রিকশাচালক লুৎফর রহমান ও গার্মেন্টসে কর্মরত তার স্ত্রী আসমা প্রায় ১০ বছর ধরে এই বস্তিতে থাকেন। আগুন লাগার সময় তারা দুজনেই কাজের জন্য বাইরে ছিলেন। ফিরে এসে দেখেন তাদের দুই সন্তানের সংসার ও ঘরের সবকিছুই পুড়ে ছাই। রাতের আঁধারে স্ত্রী-সন্তানকে খুঁজে বের করাই তাদের মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাব্বির জমানো টাকা ছাই: সিটি করপোরেশনের সড়ক মেরামতের কাজ করা রাব্বি জানান, আগুন লাগার সময় তিনি মোহাম্মদপুরে ছিলেন এবং তার স্ত্রীও ছিলেন গার্মেন্টসে। আগুনে তাদের ঘর পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি ঘরে জমানো ২০ হাজার টাকাও পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘ঘরে কিছুই পাইনি। সব শ্যাষ। এই রাতে থাকব কই।’

কিস্তির বোঝায় লাভলী বেগম: আগুনে ঘর পুড়ে যাওয়া লাভলী বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, অনেক কষ্টে কিস্তিতে টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র কিনেছিলেন। এখন জিনিসপত্রও নেই, অথচ কিস্তির টাকা শোধ করতে হবে।

কড়াইল বস্তিতে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ইতিহাস এবং কেন এই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

বারবার দুর্ঘটনা: কড়াইল বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নতুন নয়। চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ভয়াবহ আগুনে ৬১টি ঘর পুড়ে গিয়েছিল। এর দুই মাস আগে ২০২৪ সালের ১৮ ডিসেম্বরও একই এলাকায় আগুন লাগে।

কারণ বিশ্লেষণ: বস্তির ঘরগুলো টিন, বাঁশ, কাঠ ও লোহার মতো দাহ্য পদার্থ দিয়ে তৈরি এবং একে অপরের সঙ্গে লাগোয়া। এছাড়া, অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগের কারণেই বারবার এমন দুর্ঘটনা ঘটছে বলে ফায়ার সার্ভিস এর কর্মকর্তারা মনে করেন।

উপেক্ষিত নিরাপত্তা: স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, বারবার আগুন লাগার পরও বস্তির মানুষের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

অন্ধকারাচ্ছন্ন বস্তি ও মানবিক সহযোগিতা

অগ্নিকাণ্ডের পর বস্তির পরিবেশ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

বিদ্যুৎহীন কড়াইল: অগ্নিকাণ্ডের কারণে পুরো কড়াইল বস্তি এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। স্থানীয়রা মোবাইল ফোনের আলো বা টর্চ লাইট ব্যবহার করে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে নিজেদের মূল্যবান জিনিসপত্র খোঁজার চেষ্টা করছেন।

মালামাল স্থানান্তরের চেষ্টা: যেসব ঘর এখনও অক্ষত আছে, কিন্তু আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেখান থেকে বাসিন্দারা তাদের জিনিসপত্র মাথায় বা হাতে করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন।

হেলিকপ্টার না পাওয়ার ক্ষোভ: বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের কয়েকজন অভিযোগ করেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে হেলিকপ্টার চাওয়া হলেও তা পাঠানো হয়নি। তাদের প্রশ্ন, “গরিব বলে কি আমাদের অবহেলা করা হচ্ছে? আন্দোলনের সময় তো হেলিকপ্টার নামে, এখানে কেন নয়?”

বস্তির বাসিন্দা সুমন আহম্মেদ (কোট): “আগুন লাগার খবর শুইনা দৌড়াইয়া আইসা দেখি সব শেষ। স্ত্রী ও দুই সন্তান বের হইতে পারছে, কিন্তু কিছুই সঙ্গে নিয়ে বের হতে পারে নাই।”

সমাজের প্রান্তিক মানুষের অনিশ্চয়তা

বিশেষজ্ঞদের মতে, কড়াইল বস্তির অগ্নিকাণ্ড সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও আবাসন সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করে।

আবাসনের প্রশ্ন: রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর পাশে এই বিপুল সংখ্যক মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ বস্তিতে বসবাস নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা তুলে ধরে। এই মানুষগুলোর জন্য নিরাপদ ও টেকসই আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত।

ত্রাণ ও পুনর্বাসন: ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দ্রুততম সময়ে জরুরি খাদ্য, বস্ত্র এবং অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। কেবল আর্থিক সহায়তা যথেষ্ট নয়, তাদের জীবিকা পুনরুদ্ধারেও সরকারকে সহায়তা দিতে হবে।

কাঠামোগত পরিবর্তন: এই ধরনের অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হলে বস্তির অবকাঠামোতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ এবং পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে কড়াইল বস্তিবাসী

কড়াইল বস্তির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিছক একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি প্রান্তিক মানুষের অসহায়তা ও অনিশ্চিত জীবনযাত্রার প্রতীক। পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলা আগুনে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া হাজারো পরিবারের সামনে এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে নেওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে এই শীতের রাতে তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে দ্রুত এগিয়ে আসতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য জরুরি ত্রাণ ও দীর্ঘমেয়াদী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। যতদিন না বস্তির মানুষের জন্য নিরাপদ ও স্থায়ী আবাসন নিশ্চিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত “আগুনে সব শ্যাষ, এই শীতের রাতে থাকমু কই” এমন হাহাকার আমাদের শুনতে হবে।

এম আর এম – ২৩৮৪,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button