আঞ্চলিক

ভোলায় ভিজিডির চাল বিতরণে চাঁদা নেয়ার অভিযোগ ইউপি সচিবের বিরুদ্ধে

Advertisement

ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়নে সরকারি ভিজিডি (VGD) কর্মসূচির চাল বিতরণে উপকারভোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত চাঁদা নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন ওই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সচিব মেজবা উদ্দিন সম্রাট। মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) সকালে ভিজিডির তালিকাভুক্ত অসহায় লোকজন চাল নিতে গেলে তাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৪৫০ টাকা করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়। এই অনিয়মের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যা এলাকায় ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ইউপি সচিব মেজবা উদ্দিন সম্রাট গত এক বছর ধরে শম্ভুপুর ইউনিয়নে বিভিন্ন সরকারি সুবিধা (যেমন ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্ক ভাতা ইত্যাদি) বিতরণের ক্ষেত্রে নিয়মিতভাবে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে আসছেন। স্থানীয়রা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের উপজেলা পর্যায়ের প্রভাবশালী নেতাদের প্রভাবে সচিব এই চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। এই ঘটনায় ভুক্তভোগীরা উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

চাঁদা আদায়ের প্রক্রিয়া ও প্রমাণ

ভিজিডি চাল বিতরণের সময় কীভাবে এই চাঁদা আদায় করা হচ্ছিল এবং তা কীভাবে সামনে এলো।

চাঁদার পরিমাণ: অভিযোগ অনুযায়ী, ভিজিডির চাল গ্রহণের জন্য প্রতিটি কার্ডধারী উপকারভোগীর কাছ থেকে ইউপি সচিবের নির্দেশে ৪৫০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। ভিজিডি কর্মসূচির নীতিমালা অনুযায়ী, এই চাল সম্পূর্ণরূপে বিনামূল্যে বিতরণ করার কথা।

সরাসরি টাকা সংগ্রহ: টাকা সংগ্রহের কাজটি সরাসরি ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার জামাল চৌকিদার করেছেন বলে জানা গেছে।

চৌকিদারের স্বীকারোক্তি: চৌকিদার জামাল চৌকিদার সাংবাদিকদের সামনে স্বীকার করেছেন যে, তিনি ইউপি সচিব মেজবা উদ্দিন সম্রাটের নির্দেশে টাকা সংগ্রহ করেছেন এবং এতে তার নিজের কোনো দোষ নেই। তার এই বক্তব্য অভিযোগটিকে আরও জোরালো করেছে।

ভিডিও ভাইরাল: অতিরিক্ত চাঁদা নেওয়ার ঘটনার সময়কার ভিডিও ফুটেজ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যা এই দুর্নীতির সুস্পষ্ট প্রমাণ হিসেবে কাজ করছে।

এক বছর ধরে নিয়মিত অর্থ আদায়

ইউপি সচিব মেজবা উদ্দিন সম্রাটের বিরুদ্ধে এর আগেও সরকারি সুবিধা বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ ছিল।

দীর্ঘদিনের অভিযোগ: স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ইউপি সচিব মেজবা উদ্দিন সম্রাট শুধু ভিজিডি চাল নয়, গত এক বছর ধরে এই ইউনিয়নে অবস্থানকালে বিভিন্ন সরকারি সুবিধা যেমন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, এবং বিভিন্ন ত্রাণ কর্মসূচির সুবিধা দিতে গিয়ে নিয়মিতভাবে উপকারভোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ বা ঘুষ আদায় করে আসছেন।

রাজনৈতিক প্রভাব: নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক উপকারভোগী জানিয়েছেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকার কারণেই সচিব সম্রাট এতো বড় অঙ্কের চাঁদাবাজি করার সাহস পাচ্ছেন। এই রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে স্থানীয় সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতেও ভয় পাচ্ছেন।

নিয়মিত অনিয়ম: প্রতিবার সরকারি সুবিধা আসার সময়ই সচিবের বিরুদ্ধে অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠলেও, কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি এই অনিয়ম চালিয়ে যেতে উৎসাহিত হয়েছেন।

উপকারভোগীদের প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব

অসহায় দরিদ্র মানুষগুলোর ওপর এই অতিরিক্ত চাঁদা আদায়ের প্রভাব এবং তাদের ক্ষোভ। ভিজিডি কর্মসূচির চাল মূলত দেওয়া হয় চরম দরিদ্র ও অসহায় নারীদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য। এই সুবিধা পেতে গিয়ে ৪৫০ টাকা চাঁদা দেওয়া তাদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা ও চরম কষ্টের কারণ

চাঁদা আদায়ের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর শম্ভুপুর ইউনিয়নের উপকারভোগী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। অনেকেই টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেও তাদের জোরপূর্বক টাকা দিতে বাধ্য করা হয়েছে।

ভুক্তভোগীরা স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে ইউপি সচিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তাদের আদায়কৃত অর্থ ফেরত পাওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

প্রতিক্রিয়া: ইউএনওর আশ্বাস ও সচিবের নীরবতা

অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন ও ইউপি সচিবের বক্তব্য।

ইউপি সচিবের নীরবতা: চাঁদা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে শম্ভুপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সচিব মেজবা উদ্দিন সম্রাটের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। তার এই নীরবতা অভিযোগের সত্যতাকেই আরও জোরালো করছে।

উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বক্তব্য: তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শুভ দেবনাথ এই অভিযোগের বিষয়ে অবগত আছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “অতিরিক্ত চাঁদা নেওয়ার কথা শুনেছি। ভুক্তভোগীরা লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।” ইউএনওর এই আশ্বাস স্থানীয়দের মধ্যে কিছুটা ভরসা জুগিয়েছে।

সরকারি ত্রাণ কার্যক্রমে দুর্নীতি

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরনের সরকারি ত্রাণ কার্যক্রমে দুর্নীতি কীভাবে দরিদ্রদের জীবনকে প্রভাবিত করছে।

খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষতি: ভিজিডি-এর মতো খাদ্য সহায়তার উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে এই সুবিধা থেকে অর্থ কেটে নিলে তা কর্মসূচির মূল লক্ষ্যকে ব্যাহত করে এবং দরিদ্রদের কষ্ট বাড়ায়।

স্থানীয় সরকারের দুর্বলতা: ইউপি সচিব স্থানীয় সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা। তাঁর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দুর্বলতা তুলে ধরে।

তদন্তের প্রয়োজনীয়তা: ইউএনওর পক্ষ থেকে তদন্তের আশ্বাস এলেও, দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে শুধু সচিব নয়, এর সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক প্রভাবশালী বা অন্য কারো হাত থাকলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা জরুরি।

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি

ভোলার শম্ভুপুর ইউনিয়নে অসহায় ভিজিডি কার্ডধারীদের কাছ থেকে চাল বিতরণে অতিরিক্ত চাঁদা আদায়ের ঘটনা একটি মারাত্মক দুর্নীতি। যেখানে সরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সহায়তায় ভিজিডি কর্মসূচির মতো উদ্যোগ নেয়, সেখানে ইউপি সচিবের মতো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কর্তৃক এই ধরনের চাঁদাবাজি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। যেহেতু চাঁদা আদায়ের ভিডিও প্রমাণ এবং চৌকিদারের স্বীকারোক্তি রয়েছে, তাই উপজেলা প্রশাসনের উচিত, কোনো বিলম্ব না করে দ্রুত তদন্ত শুরু করা। স্থানীয়দের দাবি, কেবল সাময়িক বরখাস্ত নয়, এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক, যাতে ভবিষ্যতে কেউ সরকারি ত্রাণ কার্যক্রমে এমন দুর্নীতি করার সাহস না পায়। সরকারের উচিত, স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি সুবিধা বিতরণে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য আরও কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা তৈরি করা।

এম আর এম – ২৩৮৩,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button