রাজধানীর তেজগাঁও সংলগ্ন কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে লাগা এই আগুন দ্রুতই বড় আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং রাত ৯টা পর্যন্ত তা দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখা যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ১৬টি ইউনিট, তবে বস্তির ভেতরে পানির তীব্র অভাব এবং ঘনবসতির কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেগ পেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের। আরও কয়েকটি ইউনিট ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম সাংবাদিকদের জানান, বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে আগুনের খবর পাওয়ার পর প্রথমে সাতটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। কিন্তু আগুনের ভয়াবহতা দেখে পর্যায়ক্রমে ইউনিটের সংখ্যা বাড়ানো হয় এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে তা ১৬টিতে উন্নীত হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। তবে বস্তির অনেকগুলো ঘর পুড়ে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
অগ্নিকাণ্ডের বিস্তারিত ও ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতা
অগ্নিকাণ্ড শুরুর সময়, আগুনের ভয়াবহতা এবং তা নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের পদক্ষেপ।
আগুনের সূত্রপাত: মঙ্গলবার বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে কড়াইল বস্তির বৌ বাজার অংশে প্রথম আগুনের সূত্রপাত ঘটে। বস্তির ঘরগুলো লাগোয়া এবং দাহ্য পদার্থে পূর্ণ হওয়ায় আগুন দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ইউনিট বৃদ্ধি: শুরুতে সাতটি ইউনিট কাজ শুরু করলেও আগুনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তা পর্যায়ক্রমে বাড়িয়ে ১৬টি করা হয়। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে আরও ৩ থেকে ৫টি ইউনিট পথে রয়েছে বলেও জানানো হয়।
নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা: বস্তির ভেতরের সংকীর্ণ রাস্তা, লাগোয়া ঘর এবং পানির অপ্রতুলতার কারণে ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে মারাত্মক বেগ পাচ্ছেন। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা বলছেন, বস্তির ভেতরের অবকাঠামো অগ্নিনির্বাপণের জন্য খুবই প্রতিকূল।
কড়াইল বস্তির ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ
রাজধানীর অভিজাত এলাকার পাশে অবস্থিত কড়াইল বস্তি প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়।
অবস্থান ও আয়তন: কড়াইল বস্তি রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান ও বনানীর সংলগ্ন প্রায় ৯০ একর জায়গার ওপর অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বস্তি।
ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা: এই বস্তিতে আনুমানিক ১০ হাজারেরও বেশি ঘর রয়েছে, যা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। ঘরগুলো বেশিরভাগই টিন, কাঠ ও বাঁশের তৈরি, যা আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার প্রধান কারণ।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ: বস্তির বেশিরভাগ ঘর অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ নিয়ে পরিচালিত হয়। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রায়ই এই অবৈধ সংযোগকে অগ্নিকাণ্ডের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন।
অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি
চলতি বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে এই বস্তিতে লাগা আগুনে অন্তত ডজনখানেক ঘর পুড়ে গিয়েছিল।
গত বছরের ঘটনা: গেল বছরের ২৪ মার্চ ও ১৮ তারিখেও বস্তির বিভিন্ন অংশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এই পুনরাবৃত্তি বস্তিবাসীর নিরাপত্তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তুলেছে।
বারবার কেন আগুন: বিশ্লেষকরা বলছেন, বস্তির অপরিকল্পিত নির্মাণ, দাহ্য পদার্থের সহজলভ্যতা, ত্রুটিপূর্ণ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ এবং পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অভাবই এই ধরনের দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।
ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক দিক
এই অগ্নিকাণ্ডের ফলে বস্তির দরিদ্র মানুষেরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি: রাত ৯টা পর্যন্ত আগুন জ্বলতে থাকায় ধারণা করা হচ্ছে, বিপুল সংখ্যক ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। এই ঘরগুলোতে বসবাসকারী নিম্ন আয়ের মানুষজনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
জীবিকার ক্ষতি: ঘরবাড়ি হারানোর পাশাপাশি বস্তির মানুষজন তাদের সঞ্চয়, আসবাবপত্র এবং জীবিকার উৎসও হারিয়েছেন। এই ক্ষতি তাদের জীবনকে আরও কঠিন করে তুলবে।
বাসিন্দাদের উদ্বেগ: আগুনের খবর শুনে বস্তির বাসিন্দারা দ্রুত তাদের ঘর থেকে জরুরি জিনিসপত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। অনেকেই তাদের জীবনের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম (কোট): “বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে কড়াইল বস্তিতে আগুন লাগার খবর পেয়েছি। আগুন নেভাতে ১৬টি ইউনিট ঘটনাস্থলে কাজ করছে। পানির অভাবে নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হচ্ছে।”
বস্তির মানুষের নিরাপত্তা কেন উপেক্ষিত?
বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও কড়াইল বস্তির মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি।
দীর্ঘমেয়াদী সমাধান: বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বস্তির অগ্নিকাণ্ড একটি কাঠামোগত সমস্যা, যার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজন। শুধু বারবার আগুন নেভানোর উদ্যোগ না নিয়ে, বস্তির মানুষদের জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
অবৈধ সংযোগ উচ্ছেদ: সরকারের পক্ষ থেকে অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ উচ্ছেদে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এই সংযোগগুলোই অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের কারণ।
সচেতনতার অভাব: বস্তির বাসিন্দাদের মধ্যেও অগ্নিকাণ্ড রোধে সচেতনতার অভাব রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নিয়মিত মহড়া এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রমের প্রয়োজন।
অগ্নিপরীক্ষায় বস্তিবাসী
কড়াইল বস্তির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, নগরীর ঘনবসতিপূর্ণ বস্তিগুলোর মানুষজন কী ধরনের ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করে। ফায়ার সার্ভিসের ১৬টি ইউনিট রাতভর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলেও, পানির অভাবে ও প্রতিকূল অবকাঠামোতে তা কঠিন হয়ে পড়েছে। হতাহতের খবর না পাওয়া গেলেও, নিম্ন আয়ের হাজার হাজার মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা। এখন প্রয়োজন অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি বস্তিবাসীর জন্য নিরাপদ ও টেকসই আবাসন ব্যবস্থার বিষয়ে সরকারের সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ। যতক্ষণ না এই বস্তির মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কড়াইল বস্তি এভাবেই অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখীন হতে থাকবে।
এম আর এম – ২৩৭৮,Signalbd.com



