আঞ্চলিক

কেন্দ্রীয় কারাগার থে‌কে জা‌মি‌নে মুক্ত হলেন ৩৫ বি‌ডিআর সদস্য

Advertisement

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে সোমবার (২৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় মুক্তি পেয়েছেন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) সাবেক ৩৫ সদস্য। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে তারা পর্যায়ক্রমে কারাগার থেকে বের হন। এসময় কারাগারের ফটকের সামনে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর স্বজনদের আবেগঘন উপস্থিতি দেখা যায়।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার আদালত বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় এই ৩৫ জনসহ মোট ৫৩ জনের জামিন মঞ্জুর করেন। মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১ জন, কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১ থেকে ২ জন এবং পার্ট-২ থেকে ৩২ জন রয়েছেন। দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর পর কারামুক্তির পর সাবেক বিডিআর সদস্যদের স্বজনদের মধ্যে স্বস্তি ও আবেগ প্রকাশ পায়।

জামিনের প্রক্রিয়া ও মুক্তিদান

আদালতের জামিনের নির্দেশ কারাগারে পৌঁছানোর পর প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই শেষে কারাবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়।

কাগজপত্র পৌঁছানো: কারাগার সূত্রে জানা যায়, জামিনপ্রাপ্ত ৩৫ জন সাবেক বিডিআর সদস্যের জামিনের কাগজপত্র সোমবার দুপুরে কারাগার কর্তৃপক্ষের কাছে এসে পৌঁছায়।

যাচাই-বাছাই: এরপর কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষ দ্রুততার সাথে জামিনের আদেশ এবং অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের কাজ সম্পন্ন করে।

পর্যায়ক্রমিক মুক্তি: যাচাই-বাছাই শেষে সন্ধ্যায় প্রায় সাড়ে ৬টা থেকে সাবেক এই বিডিআর সদস্যরা পর্যায়ক্রমে কারাগার থেকে বের হতে শুরু করেন।

কাশিমপুর কারাগার কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

মুক্তিপ্রাপ্ত সদস্যরা কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের তিনটি ইউনিট থেকে মুক্তি লাভ করেন। কারাগার কর্তৃপক্ষ মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

হাই সিকিউরিটি কারাগার: কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আল মামুন বলেন, দুপুরে ১ জন সাবেক বিডিআর সদস্যের জামিনের কাগজপত্র কারাগারে পৌঁছালে যাচাই-বাছাই শেষে সন্ধ্যায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।

পার্ট-১ ও পার্ট-২: কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১ থেকে ২ জন সাবেক বিডিআর সদস্যকে মুক্তি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সিনিয়র জেল সুপার আবু নূর মো. রেজা। অপরদিকে, কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ থেকে ৩২ জন সাবেক বিডিআর সদস্যকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন সিনিয়র জেল সুপার মো. আল মামুন।

মুক্তির পর স্বজনদের আবেগ ও প্রতিক্রিয়া

দীর্ঘ কারাবাসের পর প্রিয়জনদের ফিরে পেয়ে কারাফটকের সামনে অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের মধ্যে সৃষ্টি হয় এক আবেগঘন পরিবেশ।

স্বস্তির অনুভূতি: কারামুক্ত সাবেক বিডিআর সদস্য আব্দুল্লাহ আল মামুনের বড় বোন কামরুন্নাহার তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, “একসময় ভাবতাম আদৌও ভাইকে পাব কিনা এমনটি মনে হচ্ছিল। আজকে ভাইকে সামনা-সামনি পেয়ে অনেক ভালো লাগছে।”

কৃতজ্ঞতা ও কষ্টের স্মৃতি: তিনি মুক্তি প্রক্রিয়াতে যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান। একইসঙ্গে তিনি তার পারিবারিক কষ্টের স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমার ভাইয়ের চিন্তায় বাবা মারা যান। মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এখন মায়ের বুকে ছোট ভাইকে তুলে দিতে পারলে কিছুটা স্বস্তি পাব।”

বাকিদের মুক্তির প্রত্যাশা: কামরুন্নাহার ভেতরে এখনও আটক থাকা অন্যান্য সাবেক বিডিআর সদস্যদেরও দ্রুত মুক্তি লাভের জন্য প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। তার কথায়, “ভেতরে যারা রয়েছে তারাও যেন মুক্তি পায়।”

বিডিআর বিদ্রোহের পূর্বপটভূমি

মুক্তিপ্রাপ্ত এই সদস্যরা যে মামলার আসামি, সেই বিডিআর বিদ্রোহ ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ভয়াবহ ও মর্মান্তিক ঘটনা।

সময় ও স্থান: ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে এই বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে।

ক্ষয়ক্ষতি: বিদ্রোহে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ সেনা কর্মকর্তা নিহত হন। সব মিলিয়ে ৭৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনা দেশের সামরিক ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত।

মামলা: বিদ্রোহের ঘটনায় পরদিন ও ২৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা মামলা এবং বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি পৃথক মামলা হয়। হত্যার ঘটনায় করা মামলায় ৮৫০ জনকে আসামি করা হয়, যা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা হিসেবে বিবেচিত।

মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া ও বর্তমান অবস্থা

বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ ও জটিল ছিল এবং বর্তমানেও উচ্চ আদালতে বিচারাধীন।

বিচারিক আদালতের রায়: ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর বিচারিক আদালত হত্যা মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন।

উচ্চ আদালতের রায়: নিম্ন আদালতের রায়ের পর মামলাটি হাইকোর্টে আপিল করা হয়। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টের রায়ে ১৩৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৮৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২০০ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিস্ফোরক আইনের মামলা: বর্তমানে হত্যা মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও হয়নি। আর এই ৩৫ জন সদস্য বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলায় জামিন লাভ করলেন। এটি নির্দেশ করে যে মামলার আইনি প্রক্রিয়া বিভিন্ন ধাপে এখনও চলমান রয়েছে।

বিশ্লেষণ ও পরবর্তী ধাপ

বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৩৫ জন সদস্যের জামিনে মুক্তি আইনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং বিচারিক ধাপের জটিলতারই অংশ।

আইনের দীর্ঘসূত্রতা: দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা হওয়ায় এর আইনি প্রক্রিয়া অত্যন্ত দীর্ঘ। হাইকোর্টের রায় হলেও অনেক আসামি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেছেন, যার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি এখনও বাকি।

জামিনের গুরুত্ব: বিস্ফোরক আইনের মামলায় জামিন পাওয়া কারাবন্দিদের জন্য একটি বড় স্বস্তির বিষয়। তবে হত্যার মূল মামলাটি এখনো উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকায়, তাদের চূড়ান্ত মুক্তি মামলার ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে।

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব: সাবেক বিডিআর সদস্যদের মুক্তি সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। একদিকে তাদের পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন, অন্যদিকে এই নৃশংস ঘটনার শিকার হওয়া পরিবারগুলো ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।

আব্দুল্লাহ আল মামুনের বড় বোন কামরুন্নাহার (কোট): “আজকে ভাইকে সামনা-সামনি পেয়ে অনেক ভালো লাগছে। এখন মায়ের বুকে ছোট ভাইকে তুলে দিতে পারলে কিছুটা স্বস্তি পাব।”

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ও ন্যায়বিচারের পথে

বিডিআর বিদ্রোহের বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় ৩৫ জন সাবেক সদস্যের জামিনে মুক্তি তাদের দীর্ঘ কারাবাসের অবসান ঘটিয়েছে। গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে স্বজনদের আবেগঘন উপস্থিতি এই মুক্তির মুহূর্তটিকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। যদিও হত্যা মামলার চূড়ান্ত বিচারিক প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি, এই জামিন আইনি প্রক্রিয়া ও মানবিক দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত ফলাফলের দিকে দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে, তবে আপাতত দীর্ঘ কারাবাসের পর এই ৩৫ জন সদস্য তাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার স্বস্তি পেলেন।

এম আর এম – ২৩৬৭,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button