বিয়ে করতে যাওয়ার পথে এক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন এক তরুণ বর। ভারতের উত্তরপ্রদেশের বাঘপতে এই মর্মান্তিক ঘটনায় মুহূর্তের মধ্যে উৎসবের পরিবেশ রূপ নিল গভীর শোকে। আনন্দ করতে করতে বরযাত্রীর বহর নিয়ে যাচ্ছিলেন বর, কিন্তু পথিমধ্যে সামান্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই ঘটল চরম বিপত্তি। উল্টো দিক থেকে আসা একটি দ্রুতগতির ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাকে চাপা দেয়।
নিহত ওই বরের নাম সুবোধ কুমার, যিনি স্থানীয় পিচকোরা গ্রামের বাসিন্দা। পুলিশ ও স্বজনদের সূত্রে জানা যায়, সুবোধ তাঁর বিয়ের দিন রোববার (২৩ নভেম্বর) রাতে বরযাত্রীসহ কনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু রাস্তায় শারীরিক অস্বস্তি বোধ করায় গাড়ি থামিয়ে তিনি রাস্তার ধারে বমি করার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন। এই আকস্মিক দুর্ঘটনা শুধু দুটি পরিবারের স্বপ্নকেই গুঁড়িয়ে দেয়নি, বরং সড়ক নিরাপত্তার বিষয়েও বড় প্রশ্ন তুলেছে।
বরযাত্রীর উল্লাস পরিণত হলো আর্তনাদে
যে রাতটি দুটি পরিবারের উল্লাসে মেতে ওঠার কথা ছিল, সেই রাতই পরিণত হলো গভীর বিষাদের রাতে। আনন্দযাত্রা হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো এক নিমিষের ভুলে।
সামান্য অসুস্থতা থেকে বিপর্যয়: স্বজনরা জানান, বরের গাড়িতে থাকা সুবোধ কুমার রাস্তায় চলার সময় সামান্য অস্বস্তি ও বমি করার প্রবণতা অনুভব করেন। তাই দ্রুত গাড়ি থামিয়ে তিনি রাস্তার পাশে নেমে দাঁড়ান। এটাই তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়ায়।
ঘাতক ট্রাকের হানা: স্বজনরা গাড়ি থেকে নামার আগেই বিপরীত দিক থেকে দ্রুতগতিতে আসা একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোজা সুবোধকে ধাক্কা দেয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ট্রাকটি বরের দেহকে কয়েক মিটার পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় এবং এরপর মুহূর্তেই চালক ট্রাক নিয়ে পালিয়ে যায়।
মুহূর্তের বিষাদ: আনন্দ-উল্লাস করতে থাকা বরযাত্রীরা চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে যান। বরযাত্রীর উল্লাস মুহূর্তের মধ্যে পরিণত হয় আর্তনাদে। সঙ্গে সঙ্গে বরযাত্রীরা সুবোধকে উদ্ধার করে দ্রুত চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যান।
ঘটনার বিস্তারিত ও নিহত সুবোধ কুমারের পরিচয়
সুবোধের বাড়ি পিচকোরা গ্রামে এবং তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র ছেলে। এই দুর্ঘটনা তাঁর পরিবারের জন্য নেমে আসা এক অপূরণীয় ক্ষতি।
চিকিৎসকের ঘোষণা: বরযাত্রীরা সুবোধকে সঙ্গে সঙ্গে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু তাঁর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় সেখান থেকে তাঁকে জেলা হাসপাতালে রেফার করা হয়। রাত সাড়ে দশটার দিকে সুবোধকে জেলা হাসপাতালে আনা হলেও কর্তব্যরত ডা. রাজ সিং তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
একমাত্র অবলম্বন: নিহত সুবোধ ছিলেন তাঁর পরিবারের একমাত্র ছেলে ও অবলম্বন। পরিবারের স্বপ্ন ছিল তাঁকে ঘিরেই। ছেলের বিয়েতে তাঁর মা-বাবা যে আনন্দের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন এক মুহূর্তে চুরমার হয়ে গেল। তাঁর বাবা-মায়ের শোকের ভাষা নেই।
পুলিশের তৎপরতা: ঘটনার খবর পেয়ে বিনাউলি থানা পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশ মরদেহের প্রাথমিক সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়। এই ঘটনায় দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছে পুলিশ।
একমাত্র সন্তানের অকাল মৃত্যু: শোকের সাগরে দুই পরিবার
এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা শুধু বরের পরিবারকেই নয়, কনের পরিবারকেও গভীর শোকে আচ্ছন্ন করেছে। কনের বাড়িতে যখন বিয়ের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছিল, তখন পৌঁছালো বরের মৃত্যুর খবর।
কনের পরিবারের অবস্থা: কনের পরিবারও বরের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছিল। এই অপ্রত্যাশিত এবং মর্মান্তিক খবর শুনে কনে ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা শোকে ভেঙে পড়েন। যে বাড়িতে আনন্দের বাজনা বাজার কথা ছিল, সেখানে এখন কান্নার রোল।
স্বজনদের প্রতিক্রিয়া: সুবোধের এক স্বজন সুখপাল সিং জানান, “বমি করার জন্য গাড়ি থেকে নেমেছিলেন সুবোধ, তখনই ট্রাকটি তাকে চাপা দেয়। আমরা কল্পনাও করতে পারিনি, আমাদের এত বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।” এই ঘটনার আকস্মিকতা ও নিষ্ঠুরতা যেন সবাইকে নির্বাক করে দিয়েছে।
অপূরণীয় শূন্যতা: পরিবারের একমাত্র ছেলের এই অকাল মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে এক অপূরণীয় শূন্যতা। বিয়ের মাধ্যমে দুটি পরিবার যেখানে নতুন বন্ধনে যুক্ত হতে যাচ্ছিল, সেখানে এখন শুধুই দীর্ঘশ্বাস।
পুলিশের তদন্ত ও ঘাতক ট্রাকের সন্ধানে তল্লাশি
ঘাতক ট্রাকটিকে দ্রুত খুঁজে বের করা এবং সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করাই এখন পুলিশের মূল লক্ষ্য।
মামলা গ্রহণ: পুলিশ জানিয়েছে, নিহত সুবোধের পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে এবং ঘটনার তদন্তের ভিত্তিতে দ্রুত মামলা নেওয়া হবে। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ এবং পালিয়ে যাওয়া ট্রাকচালককে খুঁজে বের করতে পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখা: ঘাতক ট্রাক এবং এর চালককে শনাক্ত করার জন্য পুলিশ মহাসড়ক এবং এর আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখছে। এই ধরনের দ্রুতগতির ট্রাক শনাক্ত করার ক্ষেত্রে সিসিটিভি ফুটেজই প্রধান অবলম্বন।
ঘাতকের পালানোর কারণ: সাধারণত দুর্ঘটনার পর চালকরা আইনি ঝামেলা এড়াতে দ্রুত পালিয়ে যায়। তবে পুলিশ নিশ্চিত করেছে যে তারা পালিয়ে যাওয়া ট্রাকচালককে খুঁজে বের করতে সব ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
মহাসড়কে নিরাপত্তার প্রশ্ন ও বিশ্লেষকদের মতামত
এই দুর্ঘটনাটি ভারতের মহাসড়কগুলোতে নিরাপত্তার দুর্বলতা এবং চালকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বিষয়ে আবারও প্রশ্ন তুলেছে।
সড়ক নিরাপত্তার ঘাটতি: সড়ক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ধরনের দুর্ঘটনা প্রায়শই অতিরিক্ত গতি এবং হাইওয়েতে অপ্রত্যাশিতভাবে গাড়ি থামানোর ক্ষেত্রে দুর্বল ব্যবস্থাপনা বা সুরক্ষার অভাবে ঘটে। মহাসড়কের পাশে জরুরি অবস্থার জন্য পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ও নিরাপদ জায়গা থাকা উচিত।
বেপরোয়া ড্রাইভিং: ট্রাক বা অন্যান্য বাণিজ্যিক গাড়ির চালকদের বেপরোয়া ড্রাইভিং এবং ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা এই ধরনের দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। বিশ্লেষকদের মতে, চালকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং শাস্তির কঠোরতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
জরুরি সেবা: দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌঁছানো এবং প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আরও উন্নত জরুরি সেবার প্রয়োজন রয়েছে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা পেলে অনেক জীবন বাঁচানো সম্ভব।
ডা. রাজ সিং, জেলা হাসপাতালের চিকিৎসক (কোট): “সুবোধ কুমারকে যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখন তাঁর অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর ছিল। আঘাত এতো বেশি ছিল যে তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণই তাঁর মৃত্যুর কারণ।”
জীবনের অনিশ্চয়তা ও সড়ক সুরক্ষার গুরুত্ব
বিয়ে করতে যাওয়ার সময় বরের ট্রাকচাপায় মৃত্যুর এই ঘটনাটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক এবং জীবনের অনিশ্চয়তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। যে বাড়িতে বিয়ের সানাই বাজার কথা ছিল, সেখানে এখন বিষাদের সুর। এই ট্র্যাজেডি কেবল সুবোধের পরিবারকেই নয়, সমগ্র সমাজকেই শোকাহত করেছে। এই ঘটনাটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশের মতো পার্শ্ববর্তী দেশেও সড়ক দুর্ঘটনা একটি গুরুতর সমস্যা। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য চালকদের দায়িত্বশীলতা, ট্রাফিক আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ এবং মহাসড়কে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। দুটি পরিবারের অকাল হারানো স্বপ্ন হয়তো আর কোনোদিন ফিরবে না, কিন্তু এই ট্র্যাজেডি যেন সড়ক নিরাপত্তার গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য এক চূড়ান্ত বার্তা হয়ে থাকে।
এম আর এম – ২৩৫৭,Signalbd.com



