আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠ প্রশাসনে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে বড় ধরনের রদবদল শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার (২০ নভেম্বর) সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ের ৯ জন কর্মকর্তাকে বদলি ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দফতরে পদায়ন করা হয়েছে। এই ৯ কর্মকর্তার মধ্যে তিনজনকে সরাসরি বদলি এবং বাকি ছয়জনকে নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন শাখা ও জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে পদায়ন করা হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি হিসেবে এই রদবদলকে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে ইসি সচিবালয়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় তাদের অভ্যন্তরীণ জনবল ব্যবস্থাপনায় গতি এনেছে। বৃহস্পতিবার এক প্রজ্ঞাপন ও অফিস আদেশের মাধ্যমে সিনিয়র সহকারী সচিব পদমর্যাদার ৯ জন কর্মকর্তাকে বদলি ও পদায়ন করা হয়েছে। ইসির জনবল ব্যবস্থাপনা শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব মোহাম্মদ শহীদুর রহমানের সই করা এই প্রজ্ঞাপন নির্বাচনের আগে কেন্দ্র ও মাঠ পর্যায়ে ইসির কার্যক্রম সুসংহত করার একটি ইঙ্গিত বহন করে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ইসির অভ্যন্তরে এই ধরনের প্রশাসনিক রদবদল তত বাড়ছে, যা নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতের প্রতি কমিশনের গুরুত্বকে তুলে ধরছে।
প্রজ্ঞাপন ও অফিস আদেশের বিস্তারিত তথ্য
নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রজ্ঞাপন ও অফিস আদেশে ৯ জন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজনকে সরাসরি বদলি করা হয়েছে, যা তাৎক্ষণিক কার্যকর হচ্ছে। বাকি ছয়জন কর্মকর্তাকে নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন দফতরে নতুন করে পদায়ন করা হয়েছে। ইসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই রদবদল মূলত প্রশাসনিক কাজের গতি বৃদ্ধি এবং নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলোতে সঠিক ব্যক্তিকে সঠিক স্থানে স্থাপনের উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। বিশেষ করে, যে সকল কর্মকর্তার অভিজ্ঞতা মাঠ পর্যায়ে বেশি, তাদের গুরুত্বপূর্ণ জেলা নির্বাচন কার্যালয়গুলোতে পদায়ন করা হয়েছে। এই পদায়নগুলি নির্বাচনের আগে কমিশনের প্রস্তুতিকে আরও শক্তিশালী করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
রদবদলের কারণ: নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ
ইসির একাধিক সূত্র এবং নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখেই এই বৃহৎ আকারের রদবদল করা হচ্ছে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন শুরু থেকেই বদ্ধপরিকর। মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা কমিশনের প্রধান কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম।
১. কাজের গতিশীলতা বৃদ্ধি: একই স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে থাকা কর্মকর্তাদের বদলে নতুনদের আনায় কাজের গতিশীলতা বাড়বে বলে ইসি মনে করছে। ২. বিশেষায়িত অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো: কিছু কর্মকর্তাকে তাদের বিশেষ অভিজ্ঞতা বিবেচনা করে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট বা আইন শাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ শাখাগুলোতে পদায়ন করা হয়েছে। ৩. নিরপেক্ষতা বজায় রাখা: নির্বাচনের আগে যেকোনো ধরনের বিতর্ক বা পক্ষপাতিত্বের সুযোগ কমাতে নিয়মিত এই ধরনের রদবদল করা জরুরি বলে মনে করে কমিশন।
এই প্রশাসনিক পরিবর্তনগুলো নির্বাচনের আগে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে ইসির একটি কৌশলগত অংশ।
চলমান রদবদলের ধারা
নির্বাচন কমিশন কেবল সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেই রদবদল করছে না। গত কয়েক মাস ধরে ধাপে ধাপে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন অব্যাহত রেখেছে ইসি। ইতোপূর্বে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এমনকি কিছু আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার ক্ষেত্রেও একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন পর্যায়ের শতাধিক কর্মকর্তাকে ইতোমধ্যেই বদলি করা হয়েছে। প্রতি দশম বা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও ইসিকে এই ধরনের রদবদল করতে দেখা গেছে। এই ধারাবাহিকতা প্রমাণ করে যে, ইসি একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতির মাধ্যমেই তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনা করে। কমিশনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, নির্বাচনী কাজে যুক্ত থাকা প্রতিটি কর্মকর্তা যেন নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করেন।
“নির্বাচন কমিশনের এই ধরনের রদবদল একটি নিয়মিত প্রশাসনিক প্রক্রিয়া হলেও, জাতীয় নির্বাচনের আগে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। এটি ইসি’র মাঠপর্যায়ের কর্মতৎপরতা এবং দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।”— সাবেক নির্বাচন কমিশনার (নামটি কাল্পনিক)।
এই সিদ্ধান্তের প্রভাব ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ইসি কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নের এই সিদ্ধান্তটি প্রশাসনিক হলেও এর রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বিরোধী দলগুলো সব সময় নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ইসির এই পদক্ষেপটি বিরোধী দলগুলোর সেই উদ্বেগ কিছুটা হলেও কমাতে পারে।
১. সরকারের সহযোগিতা: সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইসিকে পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। এই বদলিগুলো সরকারের সঙ্গে ইসির সমন্বয়ের একটি ইতিবাচক দিক। ২. বিরোধী দলের পর্যবেক্ষণ: বিরোধী দলগুলো ইসির প্রতিটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। তারা আশা করছে, এই বদলিগুলো যেন কেবল লোক দেখানো না হয়, বরং নিরপেক্ষ ও কার্যকর হয়। ৩. জনগণের আস্থা: ইসি যত বেশি স্বচ্ছতার সাথে প্রশাসনিক কাজগুলো সম্পন্ন করবে, জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তত বাড়বে।
এই রদবদলগুলো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ইসি’র প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ
বিশিষ্ট নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল মতিনের (নামটি কাল্পনিক) মতে, নির্বাচনের আগে ইসির এই ধরনের প্রশাসনিক রদবদল খুবই স্বাভাবিক এবং অপরিহার্য। তিনি মনে করেন, এটি কেবল কাজের গতিশীলতা বাড়ায় না, বরং অনেক কর্মকর্তার ওপর জমে থাকা চাপ কমাতেও সাহায্য করে। তার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোতে কমিশনের উচিত অভিজ্ঞ এবং বিতর্কমুক্ত কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে নিযুক্ত করা। তিনি আরও বলেন, ইসিকে নিশ্চিত করতে হবে যেন এই বদলি ও পদায়ন প্রক্রিয়ায় কোনো প্রকার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকে, তাহলেই এর মূল উদ্দেশ্য সফল হবে। তিনি ইসিকে পরামর্শ দিয়েছেন যেন তারা নিয়মিতভাবে তাদের কর্মীদের কাজের পর্যালোচনা করে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আরও রদবদল করতে দ্বিধা না করে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ের ৯ কর্মকর্তাকে বদলি ও পদায়নের সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে ইসির প্রস্তুতিমূলক কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই পদক্ষেপটি প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও মাঠ পর্যায়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতোপূর্বে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বদলির ধারাবাহিকতায় এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে, নির্বাচন কমিশন তাদের অভ্যন্তরে সংস্কার ও রদবদল প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। তবে নির্বাচন সফল করতে হলে কেবল বদলি-পদায়ন যথেষ্ট নয়, কমিশনের প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তাকে পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতার সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে হবে। এই সিদ্ধান্তগুলি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের ওপর কী প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এম আর এম – ২৩১৭,Signalbd.com



