অবৈধ পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়ায় মাফিয়াদের গুলিতে নিহত হয়েছেন মাদারীপুরের তিন যুবক। তারা হলেন সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের ইমরান খান (২২), রাজৈর উপজেলার দুর্গাবর্দ্দী গ্রামের মুন্না তালুকদার (২৪) এবং একই উপজেলার ঘোষলাকান্দি গ্রামের বায়েজিত শেখ (২০)। মাফিয়াদের গুলিতে প্রাণ হারানোর পর তাদের মরদেহ সাগরে নিক্ষেপ করা হয় বলে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা জানতে পেরেছেন। এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় তাদের পরিবার ও পুরো এলাকায় গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এই মৃত্যুর জন্য স্থানীয় মানবপাচার চক্রের সদস্যদের দায়ী করেছেন স্বজনরা এবং তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
নিহতদের পরিচয় ও দালালের সাথে চুক্তির বিবরণ
নিহত তিন যুবকই মাদারীপুর জেলার বাসিন্দা। নিহতদের স্বজনরা জানান, ইতালি যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে তারা প্রতিবেশী এবং মানবপাচার চক্রের সদস্য হিসেবে পরিচিত শিপন খান ও তার বড় ভাই সেলিম খান-এর সাথে যোগাযোগ করেন। অভিযুক্ত শিপন খান লিবিয়ায় অবস্থান করেন এবং সেলিম খান দেশে বসে সব লেনদেন ও চুক্তির কাজ সারেন।
ইমরান খানের পরিবার জানায়, সরাসরি ইতালি পৌঁছে দেওয়ার শর্তে দালাল শিপন খানের সাথে ২২ লাখ টাকায় চুক্তি হয়েছিল। গত ৮ অক্টোবর ইমরান ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন। শুধু ইমরান নন, মুন্না তালুকদার এবং বায়েজিত শেখও একই চক্রের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। নিহত মুন্নার খালা খাদিজা আক্তার জানান, দালাল শিপনকে ধারদেনা করে মুন্নার পরিবারও ৪০ লাখ টাকা দিয়েছিল।
লিবিয়ায় আটক, নির্যাতন ও অতিরিক্ত অর্থ আদায়
চুক্তির পর পরই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ইমরান লিবিয়ায় পৌঁছার পর দালাল চক্র তাকে আটকে রেখে ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। তার মুক্তির জন্য পরিবার থেকে আরও ১৮ লাখ টাকা আদায় করা হয়। অর্থাৎ, শুধুমাত্র ইমরানকে ইতালি পাঠানোর জন্য মোট ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় পাচারকারীরা। নির্যাতনের শিকার ইমরান গত ১ নভেম্বর তার মায়ের সাথে শেষবারের মতো কথা বলেন। তখন তিনি জানিয়েছিলেন যে তাকে সেখানে অনেক নির্যাতন করা হচ্ছে এবং কী হবে তা তিনি জানেন না।
নিহত মুন্না ও বায়েজিতের পরিবার থেকেও মুক্তিপণের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা আদায় করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিবারগুলো তাদের সর্বস্ব বিক্রি করে এবং ঋণ করে দালালদের টাকা দিয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের সন্তানদের এমন মর্মান্তিক পরিণতি মেনে নিতে হয়েছে।
মৃত্যুর ঘটনা ও লাশ সাগরে নিক্ষেপ
ইমরান খানের মা রেহেনা বেগমকে গত মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দালাল সেলিম খান জানান যে ইমরান পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। তবে একাধিক সূত্র এবং দালাল চক্রের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নিহতের স্বজনরা দাবি করছেন, লিবিয়া থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালির উদ্দেশ্যে যাত্রার সময় ভূমধ্যসাগরে মাফিয়াদের গুলিতে তারা মারা যান। স্থানীয়দের ধারণা, দালাল শিপন খান লিবিয়ার মাফিয়াদের ঠিকমতো চুক্তি অনুযায়ী টাকা না দেওয়ায় মাফিয়াচক্র ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের হত্যা করেছে। হত্যার পর তিন যুবকের মরদেহ সাগরে নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে পরিবারের সদস্যরা জানতে পেরেছেন। এই চরম নিষ্ঠুরতার ঘটনায় পরিবারগুলো তাদের সন্তানের মরদেহটি একবারের জন্য দেখতে না পারার শোকে আহাজারি করছে।
নিহতদের স্বজনদের প্রতিক্রিয়া ও দালালদের লাপাত্ত হওয়া
তিন যুবকের মৃত্যুর খবর জানাজানি হওয়ার পরই এলাকায় শোকের মাতম শুরু হয়। নিহত ইমরানের বড় বোন ফাতেমা আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “শিপন দালাল আমার ভাইকে মেরে ফেলেছে। এই দালালের কঠিন বিচার চাই। আর সরকারের কাছে দাবি, আমার ভাইয়ের লাশটি যেন একবারের জন্য হলেও দেখতে পারে, সেই পদক্ষেপ নেওয়ার।” তিনি অভিযোগ করেন, তার ভাইকে বাঁচানোর জন্য জমি বিক্রি করে এবং ঋণ করে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছেন।
নিহত মুন্নার খালা খাদিজা আক্তার এবং বায়েজিতের বাবা কুদ্দুস শেখও একই সুরে দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কাছে আকুতি জানিয়েছেন।
এদিকে, ঘটনা জানাজানি হওয়ার সাথে সাথেই অভিযুক্ত দালাল শিপন খান ও তার বড় ভাই সেলিম খান-এর পরিবারের সদস্যরা ঘরগুলোতে তালা ঝুলিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন। দালাল শিপনের চাচী সেতারা বেগম অবশ্য দাবি করেন, শিপন অনেক মানুষকেই ইতালি নিয়েছেন, তবে গুলিতে কেউ মারা যাওয়ার বা শিপন কাউকে হত্যা করার ঘটনা তারা শোনেননি।
মানবপাচার চক্রের পূর্ব ইতিহাস ও এলাকার ক্ষোভ
স্থানীয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যক্তি জানান, লিবিয়ায় অবস্থানরত শিপন খান বেশ কয়েক বছর ধরে সেখানে বসেই মানবপাচারের কাজ চালিয়ে আসছেন। দেশে বসে তার ভাই সেলিম খানসহ পরিবারের সদস্যরা এলাকার যুবকদের সহজ উপায়ে ইতালি নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলেন। এলাকার অনেকেই অভিযোগ করেছেন, এর আগেও তাদের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার পথে বেশ কয়েকজন যুবক মারা গেছেন, কিন্তু অভিযুক্তরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। এলাকাবাসীর মধ্যে এই দালালচক্রের ওপর চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা মনে করছেন, এই দালালচক্রের সঠিক বিচার না হলে আরও অনেক যুবকের প্রাণহানি ঘটবে।
পুলিশ ও প্রশাসনের পদক্ষেপ
মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, লিবিয়ায় গুলিতে তিন যুবকের মৃত্যুর খবর তারা বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পেরেছেন। তিনি নিশ্চিত করেন, “এই ঘটনায় নিহতের পরিবার থানায় লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। অভিযুক্ত দালালচক্রকে কোনো প্রকারেই ছাড় দেওয়া হবে না।” পুলিশের পক্ষ থেকে পরিবারের সদস্যদের দ্রুত লিখিত অভিযোগ করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে যে, দালালদের চিহ্নিত করে দ্রুত গ্রেফতারের চেষ্টা করা হবে এবং আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিহতদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়েও সহায়তা করা হবে।
“দালাল শিপনকে ধারদেনা করে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছি। আমার ভাগ্নের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। এই দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। পাশাপাশি মুন্নার মরদেহ দেশে ফিরিতে আনতে সরকারের কাছে আকুতি জানাচ্ছি।” — খাদিজা আক্তার (নিহত মুন্নার খালা)
লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে মাদারীপুরের তিন তরুণের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু মানবপাচার চক্রের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা এবং তাদের লোভের চূড়ান্ত পরিণতি তুলে ধরে। স্বপ্ন পূরণের আশায় বিদেশগামী যুবকদের করুণ পরিণতি একদিকে যেমন শোকের জন্ম দিয়েছে, তেমনি দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জোরালো করেছে। প্রশাসনকে অবিলম্বে অভিযুক্ত দালালচক্রকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা এবং নিহতদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। এই ঘটনা প্রমাণ করে, বিদেশে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখিয়ে মানবপাচারকারীরা দেশের নিরীহ যুবকদের জীবন নিয়ে কতটা ছিনিমিনি খেলছে।
এম আর এম – ২২৯৮,Signalbd.com



