মাত্র ছয় মাস আট দিনে পবিত্র কোরআন শরীফ মুখস্থ করে সবার দৃষ্টি কাড়লেন শরীয়তপুরের নড়িয়ার ৯ বছরের শিশু হাসান। অধ্যবসায়, মেধা আর আল্লাহর বিশেষ কৃপায় অল্প বয়সেই সম্পন্ন করলেন হিফজুল কোরআন।
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার এক মেধাবী শিশু মাত্র ছয় মাস আট দিনে পুরো কোরআন মুখস্থ করে সকলকে অবাক করে দিয়েছে। তাহসিনুল কোরআন কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ৯ বছর বয়সী মুহাম্মাদ হাসান এই অবিশ্বাস্য কৃতিত্বের অধিকারী। সোমবার (৩ নভেম্বর) সকাল ১০টায় তার শেষ সবক সম্পন্ন হয়। আবেগঘন পরিবেশে মাদ্রাসার শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা তার সাফল্য উদযাপন করেন।
মাত্র ছয় মাসে সম্পন্ন হলো হিফজুল কোরআন
মুহাম্মাদ হাসান যখন মাদ্রাসায় ভর্তি হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। প্রথমে কায়দা, আমপারা ও নাজেরা শেষ করার পর মাত্র ছয় মাস আট দিনের মধ্যে পবিত্র কোরআন শরীফ মুখস্থ সম্পন্ন করে সে। সাধারণত একজন শিক্ষার্থীকে হাফেজ হতে তিন বছর পর্যন্ত সময় লাগে, কিন্তু হাসান নিজের একাগ্রতা, নিয়মিত অধ্যবসায় এবং সময়নিষ্ঠা দিয়ে সকলের প্রত্যাশা ছাড়িয়ে গেছে।
মাদ্রাসার শিক্ষকদের ভাষায়, প্রতিদিন সকালে ফজরের নামাজের পর থেকে দুপুর পর্যন্ত সে নিরবচ্ছিন্নভাবে হিফজের ক্লাস করত। বিকেলেও পুনরাবৃত্তি করত সে। তার অধ্যবসায় দেখে শিক্ষকরা শুরু থেকেই বুঝেছিলেন, এই শিশুটি আল্লাহর বিশেষ দান।
অভিভাবকের চোখে সন্তানের সাফল্য
হাসানের বাবা শওকত হাওলাদার একজন সাধারণ কৃষক ও ফল ব্যবসায়ী। নিজের জীবনের কষ্টের মধ্যেও তিনি চেয়েছিলেন ছেলেকে ধর্মীয় শিক্ষায় গড়ে তুলতে। তিনি বলেন,
“ছোটবেলা থেকেই আমি চেয়েছি আমার ছেলে যেন নামাজ ও কোরআনের পথে চলে। আল্লাহর অশেষ রহমতে সে অল্প বয়সেই পুরো কোরআন মুখস্থ করেছে — এটি আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন।”
মা-ও সমানভাবে ছেলের অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। পরিবারের সবাই প্রতিদিন তাকে সময়মতো ঘুমাতে ও উঠতে সাহায্য করতেন, যেন সে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে।
শিক্ষক ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া
তাহসিনুল কোরআন কওমি মাদ্রাসার মুহতামিম হাফেজ আবদুস সাত্তার বলেন,
“সাধারণত একজন শিক্ষার্থীকে সম্পূর্ণ হিফজ শেষ করতে অন্তত তিন বছর সময় লাগে। কিন্তু হাসান সেই নিয়ম ভেঙে দিয়েছে। সে অত্যন্ত পরিশ্রমী, সময়নিষ্ঠ ও মনোযোগী। আল্লাহর অনুগ্রহ এবং তার নিজের চেষ্টাতেই এত দ্রুত সময়ের মধ্যে হিফজ সম্পন্ন করতে পেরেছে।”
তিনি আরও জানান, মাদ্রাসার ইতিহাসে এমন দ্রুত হিফজ সম্পন্ন করার ঘটনা এই প্রথম। হাসানের এই সাফল্য প্রতিষ্ঠানটির জন্যও এক বিশাল সম্মানের বিষয়।
গ্রামজুড়ে আনন্দের বন্যা
হাসানের সাফল্যের খবর ছড়িয়ে পড়তেই তার গ্রামে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়। স্থানীয় মসজিদে বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়। প্রতিবেশীরা মিষ্টি বিতরণ করেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আনন্দ মিছিলও করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, “হাসান আমাদের গ্রামের গর্ব। এত অল্প বয়সে এমন সাফল্য কল্পনাই করা যায় না। আল্লাহ তাকে আরও উচ্চ মর্যাদা দান করুন।”
বাংলাদেশে শিশু হাফেজদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কম বয়সে হিফজুল কোরআন সম্পন্ন করার হার বেড়েছে। অনেক শিশুই বর্তমানে এক বছরেরও কম সময়ে হিফজ সম্পন্ন করছে। এটি দেশের ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মানুষের আগ্রহ ও পরিবারের ভূমিকার একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।
ইসলামী শিক্ষাবিদরা মনে করেন, প্রযুক্তির যুগে যখন শিশুরা নানা বিভ্রান্তির মধ্যে বেড়ে উঠছে, সেখানে কোরআন শিক্ষা তাদের নৈতিকতা, একাগ্রতা ও চরিত্র গঠনে অসাধারণ ভূমিকা রাখছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ইসলামী শিক্ষাবিদ হাফেজ আব্দুল হক বলেন,
“এ ধরনের সাফল্য আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা। যদি পরিবার ও সমাজ একসঙ্গে সহযোগিতা করে, তবে আরও অনেক শিশু অল্প বয়সে কোরআন মুখস্থ করতে পারবে।”
মুহাম্মাদ হাসানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তার শিক্ষকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে সে পুনরাবৃত্তি (দাওর) করছে এবং ভবিষ্যতে কিরাত ও ইসলামিক স্টাডিজে উচ্চশিক্ষা নিতে চায়।
৯ বছরের শিশু হাসানের এই অর্জন শুধু তার পরিবারের নয়, পুরো শরীয়তপুর জেলাবাসীর জন্য গর্বের বিষয়। এমন উদাহরণ শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি অনুপ্রেরণা জোগাবে এবং সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা আরও বাড়াবে।
তাহসিনুল কোরআন মাদ্রাসার শিক্ষক ও এলাকাবাসীরা আশা করছেন, হাসান ভবিষ্যতে একজন আদর্শ আলেম ও সমাজের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠবে।
এম আর এম – ২০৬৬,Signalbd.com



