আঞ্চলিক

ফ্রিজে রাখা খুলি ২ মাস পর লাগানো হলো মামুনের মাথায়

Advertisement

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষে আহত সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মামুন মিয়ার মাথায় সফলভাবে লাগানো হয়েছে তার সংরক্ষিত খুলি। দুই মাস ধরে ফ্রিজে রাখা ওই খুলিটি শনিবার পার্কভিউ হাসপাতালে সফল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করেন চিকিৎসকরা।

ঘটনাটির বিস্তারিত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে গত ৩১ আগস্ট সংঘর্ষে গুরুতর আহত হন সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মামুন মিয়া। দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে তার মাথার খুলি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংঘর্ষের রাতেই তাকে গুরুতর অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য পার্কভিউ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।

সেখানে নিউরোসার্জনদের তত্ত্বাবধানে তার মাথা থেকে খুলির ক্ষতিগ্রস্ত অংশ অপসারণ করে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়। প্রায় দুই মাস পর তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলে শনিবার (১ নভেম্বর) দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার অস্ত্রোপচারে খুলিটি পুনরায় প্রতিস্থাপন করা হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মু. ইসমাঈল হোসেন বলেন, “অপারেশনের পর প্রথম কয়েকদিন আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছি। খুলির প্রতিস্থাপন সফল হয়েছে এবং রোগীর অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো।”

কেন খুলিটি ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়েছিল

মামুনের মাথায় অস্ত্রোপচারের সময় তার খুলির ১৩টি ভাঙা টুকরো বের করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, মস্তিষ্কের ওপর চাপ কমাতে ও সংক্রমণ প্রতিরোধে খুলির অংশটি কিছু সময়ের জন্য অপসারণ করে সংরক্ষণ করা হয়। এটি সাধারণত গুরুতর মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের ক্ষেত্রে করা হয়।

ডা. ইসমাঈল হোসেন বলেন, “খুলির অংশ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ তাপমাত্রায় রাখা হয়, যাতে কোষগুলো নষ্ট না হয়। রোগী সুস্থ হলে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কেটে গেলে সেই হাড় আবার মাথায় লাগানো হয়।”

চিকিৎসকরা আরও জানান, ফ্রিজে খুলি সংরক্ষণ করা আধুনিক নিউরোসার্জারির একটি স্বীকৃত প্রক্রিয়া, যা বিশ্বের অনেক দেশে ব্যবহৃত হয়।

সংঘর্ষের পটভূমি

২০২৫ সালের ৩০ আগস্ট দিবাগত রাত থেকে ৩১ আগস্ট দুপুর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের মধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে মারধরের অভিযোগকে কেন্দ্র করে।

এই ঘটনায় সহ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন, তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফসহ প্রায় ২০০ জন শিক্ষার্থী ও ১০ জনের বেশি স্থানীয় বাসিন্দা আহত হন। গুরুতর আহতদের মধ্যে মামুন মিয়া ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ আহমেদ অন্যতম ছিলেন।

সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

মামুনের সহপাঠী রাসেল রানা বলেন, “আমরা অনেকদিন ধরে ওর পাশে ছিলাম। খুলিটি পুনরায় লাগানো হয়েছে শুনে সবাই স্বস্তি পেয়েছি। ও এখন অনেকটা সুস্থ, ইশারায় কথা বলছে।”

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, “মামুনের মাথায় অস্ত্রোপচারটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এটি একটি বড় অর্জন, কারণ সে ভয়াবহ আঘাত পেয়েছিল। বিভাগীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করছেন।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মামুনের সুস্থতা কামনায় পোস্ট দিচ্ছেন। অনেকে হাসপাতালের বাইরে উপস্থিত থেকেও সহমর্মিতা প্রকাশ করেন।

বিশেষজ্ঞ মতামত ও চিকিৎসাগত গুরুত্ব

চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে, খুলির অংশ প্রতিস্থাপন একটি জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্রোপচার। রোগীর রক্তচাপ, ইনফেকশন ও ব্রেন প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই সংরক্ষিত খুলি প্রতিস্থাপনের পর শরীর সেটি গ্রহণ করতে সময় নেয়।

নিউরোসার্জনরা জানান, দেশে এখন এমন জটিল অস্ত্রোপচার সফলভাবে করার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। অতীতে এমন অস্ত্রোপচারের জন্য বিদেশে যেতে হতো, কিন্তু এখন চট্টগ্রাম, ঢাকা ও সিলেটের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে এ ধরনের উন্নত সেবা পাওয়া যাচ্ছে।

বর্তমানে মামুনের শারীরিক অবস্থা

হাসপাতাল সূত্র জানায়, অপারেশনের পর মামুনের অবস্থা স্থিতিশীল। তিনি এখন কেবিনে চিকিৎসাধীন আছেন। মাথার ক্ষতস্থান সেরে উঠছে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশেষ অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দু-এক দিনের মধ্যেই তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেয়া হতে পারে।

ইমতিয়াজ আহমেদ, যিনি একই সংঘর্ষে আহত হয়েছিলেন, তিনিও ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছেন এবং বর্তমানে ফিজিওথেরাপি নিচ্ছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত মামুনের খুলির প্রতিস্থাপন সফলভাবে সম্পন্ন হওয়া শিক্ষার্থী সমাজে স্বস্তি এনে দিয়েছে। চিকিৎসকদের ভাষায় এটি দেশের নিউরোসার্জারি ক্ষেত্রে এক অনন্য সাফল্য।

তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে— এমন সংঘর্ষ আর কতবার শিক্ষাঙ্গনকে রক্তাক্ত করবে? শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবার কি স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে?

এম আর এম – ২০৬৪,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button