নরসিংদীর রায়পুরায় মাত্র এক শতাংশ জমির মালিকানা নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধের জেরে আপন চাচার হাতে প্রাণ হারালেন দুই ভাই। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জমি দখল নিয়ে সংঘর্ষের পর ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাদের।
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় মাত্র এক শতাংশ জমি নিয়ে বিরোধের জেরে দুই ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন নিহতদের আপন চাচা ও চাচাতো ভাইয়েরা। শনিবার (১ নভেম্বর) দুপুরে উপজেলার চরসুবুদ্ধি ইউনিয়নের বাজারসংলগ্ন এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে পুলিশ এবং তিনজনকে আটক করা হয়েছে।
এক শতাংশ জমির দ্বন্দ্বে দুই প্রাণহানি
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিহতরা হলেন মৃত আবু তাহের মিয়ার দুই ছেলে হুরুন আলী ওরফে হুরা (৪০) ও শাকিল মিয়া (২২)। তাঁরা দুজনই পেশায় রাজমিস্ত্রি ছিলেন। পরিবারের দাবি, তাঁদের পিতার মৃত্যুর পর থেকে চাচা আওয়াল মিয়া জমিটি নিজের বলে দাবি করে আসছিলেন।
শনিবার দুপুরে হুরুন ও শাকিল জমিতে ঘর নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময় চাচা আওয়াল মিয়া ও তাঁর দুই ছেলে শিপন ও রিপন বাধা দিতে আসেন। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তারা ১০-১২ জন সহযোগী নিয়ে লাঠি ও ধারালো দা নিয়ে দুই ভাইয়ের ওপর হামলা চালান।
স্থানীয়রা জানান, হামলাকারীরা দুই ভাইকে বেধড়ক কুপিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যায়। পরে প্রতিবেশীরা উদ্ধার করে দ্রুত নরসিংদী সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে আনার আগেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।
পুরনো ধার নিয়ে জমি দাবি
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানা গেছে, প্রায় ২০ বছর আগে আবু তাহের মিয়া তাঁর ভাই আওয়াল মিয়ার কাছ থেকে প্রায় ১৮০০ টাকা ধার নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আওয়াল মিয়া দাবি করেন, সেই টাকার বিনিময়ে আবু তাহের তাঁর এক শতাংশ জমি লিখে দিয়েছেন। কিন্তু এর কোনো দলিল দেখাতে পারেননি তিনি।
এই দাবি ঘিরে এলাকায় একাধিকবার সালিশ বৈঠক হয়, যেখানে প্রতিবারই স্থানীয় মাতব্বরেরা আবু তাহের মিয়ার দুই ছেলের পক্ষে রায় দেন। এরপরও আওয়াল মিয়া জমি দখলের চেষ্টা চালিয়ে যান, যার পরিণতি ঘটে শনিবারের এই মর্মান্তিক ঘটনায়।
পরিবারের আর্তনাদ: ‘এক টুকরো জমির জন্য দুই ভাইকে হারালাম’
নিহতদের বোন মোছলেমা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “জমি নিয়ে বিরোধের জেরে আমার দুই ভাইকে বাড়িতে এসে কুপিয়ে হত্যা করেছে চাচা আওয়াল মিয়া ও তার সন্তানরা। আমরা সালিশে গিয়েছিলাম, কিন্তু তারা কিছুই শুনতে চায়নি।”
নিহত হুরার শাশুড়ি হেলা বেগম বলেন, “আওয়াল মিয়া জাল দলিল তৈরি করে জোর করে জমি দখল করতে চাইছিল। আমার জামাই বাধা দিতে গেলে তাকে ও ছোট ভাইকে কুপিয়ে মেরে ফেলে।”
পরিবারের সদস্যরা হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
পুলিশের বক্তব্য ও আইনগত পদক্ষেপ
এ ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে। খবর পেয়ে রায়পুরা থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) সুজন চন্দ্র সরকার বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ঘটনাস্থল থেকে তিনজনকে আটক করা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে।”
রায়পুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আদিল মাহমুদ জানান, নিহতদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য নরসিংদী সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। “ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে,” বলেন তিনি।
গ্রামজুড়ে আতঙ্ক ও ক্ষোভ
চরসুবুদ্ধি এলাকার স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। মাত্র এক শতাংশ জমির জন্য দুই ভাইয়ের প্রাণহানির ঘটনাকে তারা “অমানবিক” বলে আখ্যা দিচ্ছেন। স্থানীয় প্রবীণরা বলছেন, “এমন ঘটনা আমাদের এলাকায় আগে কখনো ঘটেনি। সালিশে সমাধান না করে এমন হত্যাযজ্ঞ চালানো লজ্জাজনক।”
গ্রামবাসীরা দাবি করেছেন, জমিসংক্রান্ত বিরোধের কারণে দীর্ঘদিন ধরে এলাকাজুড়ে উত্তেজনা চলছিল। প্রশাসন যদি আগে থেকেই হস্তক্ষেপ করত, হয়তো এই হত্যাকাণ্ড এড়ানো যেত।
সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণ
সামাজিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক জমি-বিরোধ এখন গ্রামীণ বাংলাদেশে একটি মারাত্মক সামাজিক সংকটে পরিণত হয়েছে। সামান্য জমি বা সম্পত্তি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব, যা প্রায়ই রক্তক্ষয়ী ঘটনায় রূপ নেয়।
একজন স্থানীয় সমাজ বিশ্লেষক বলেন, “গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পত্তি বণ্টন বা উত্তরাধিকারের বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সালিশে সমাধান না হলে আইনগত পথে যাওয়ার আগেই অনেক সময় আবেগ ও রাগে ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নেয় মানুষ।”
তিনি মনে করেন, স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে, যাতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ করা যায়।
এক শতাংশ জমি নিয়ে শুরু হওয়া পারিবারিক বিরোধ এখন দুই প্রাণের বিনিময়ে শেষ হয়েছে। ছোট্ট জমির মালিকানা নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ সমাজে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে—মানুষের মানবিকতা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে?
এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে স্থানীয়দের দাবি, এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে শুধু শাস্তি নয়, প্রয়োজন সচেতনতা ও পারিবারিক সম্পর্কের পুনর্গঠন।
এম আর এম – ২০৩১,Signalbd.com



