কুমিল্লার মুরাদনগরের প্রতিভাবান কোরআনে হাফেজ সাইফুর রহমান ত্বকি ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স মাত্র ২৫ বছর। ত্বকির অকাল মৃত্যু কেবল পরিবার নয়, পুরো এলাকাকে শোকের ছায়ায় ভাসিয়েছে।
তার জানাজা রাতেই কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ডালপা নেদায়ে ইসলাম দাখিল মাদ্রাসা মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার ইমামতি করেন ত্বকির বাবা, মাওলানা বদিউল আলম।
জীবন এবং শিক্ষা
হাফেজ ত্বকি ২০০০ সালে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার ডালপা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। তার বাবা একজন মাদ্রাসা শিক্ষক। ছোটবেলা থেকেই ত্বকি কোরআনের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন।
তিনি ঢাকার বিখ্যাত মারকাযুত তাহফিজ থেকে কোরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জের একটি মাদ্রাসায় কিতাব বিভাগে অধ্যয়ন শুরু করেন। তাঁর শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ধাপেই স্পষ্ট প্রতিভার ছাপ ছিল।
আন্তর্জাতিক কৃতিত্ব
হাফেজ ত্বকি কেবল দেশের নয়, আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায়ও তার নাম জ্বলজ্বল করিয়েছেন। তিনি জর্ডান, কুয়েত ও বাহরাইনে অনুষ্ঠিত কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হয়ে বিজয়ী হয়েছেন।
দেশীয় টেলিভিশন অনুষ্ঠানে যেমন ‘কুরআনের আলো’-তে অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়ও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন। তাঁর কোরআনের তেলাওয়াতের নিখুঁত উচ্চারণ ও প্রাঞ্জল আবহ সারা দেশবাসীর হৃদয় ছুঁয়েছে।
মৃত্যু ও শেষ মুহূর্ত
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ত্বকি মুগদা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হাসপাতালের আইসিইউতে তিনি সর্বশেষ পর্যন্ত প্রাণসংকল্পে জিকির চালিয়ে গিয়েছিলেন। তার বাবা মাওলানা বদিউল আলম জানান, “আমি বেডের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর মুখে জিকিরের শব্দ শুনেছি। তখন আল্লাহর কাছে বললাম, হে আল্লাহ, যদি আমার ছেলের আয়ু শেষ হয়ে থাকে, তাকে ঈমানের সঙ্গে কবুল করে নিন।”
এই মুহূর্তে, ত্বকি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন—একটি অনন্য আত্মিক দৃশ্য, যা উপস্থিত সবাইকে আবেগাপ্লুত করেছে।
জানাজার দৃশ্য
ত্বকির জানাজায় অংশ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো মানুষ ছুটে আসেন। স্বজন, শিক্ষক ও স্থানীয়রা একত্রিত হয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ করেন।
জানাজার আগে ত্বকির বাবা আবেগঘন বক্তব্যে বলেন, “আমার ছেলে ইসলামী আদর্শ মেনে জীবন যাপন করেছে। তার মৃত্যুতে আমি কষ্ট পেয়েছি, তবে জানি আমার রবের সন্তুষ্টিই সর্বোচ্চ। আমি নিজে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়েছি এবং তার জন্য দোয়া করেছি। আমি নিজ হাতে তাকে সাদা কাফনে মুড়িয়ে বাড়ি এনেছি, কাঁধে নিয়েছি এবং জান্নাতে পৌঁছে দেব বলে আশা রাখছি।”
জানাজার পর, রাত ১০টার দিকে হাফেজ ত্বকিকে উত্তরপাড়া পীরমুড়ি কবরস্থানে দাফন করা হয়।
প্রভাব ও স্মৃতিচারণ
ত্বকির অকাল মৃত্যু কেবল পরিবার নয়, কোরআনপ্রেমী ও শিক্ষাজগৎকেও শোকমগ্ন করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও স্মৃতিচারণ প্রকাশ করেছেন।
তার শিক্ষক ও সহপাঠীরা স্মরণ করেন, ত্বকি ছিলেন একাধারে ধর্মীয় জ্ঞান ও মানবিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ। তিনি সবসময় জিকির ও নামাজের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর কাছে নিবেদন করতেন।
বিশ্লেষণ
বিশ্বজয়ী হাফেজ ত্বকির জীবন ও কৃতিত্ব থেকে একটি শিক্ষা পাওয়া যায়—অত্যন্ত প্রতিভা ও ধার্মিক জীবনযাপন কেবল ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা। তাঁর সময়েই তিনি দেশের নাম আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় উজ্জ্বল করেছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ত্বকির অকাল মৃত্যু আমাদের তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে যেন তারা ধর্মীয় শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধে পরিপূর্ণ জীবনযাপন করে।
বিশ্বজয়ী হাফেজ সাইফুর রহমান ত্বকির মৃত্যুর খবরে পুরো বাংলাদেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তিনি তার জীবন শেষে জিকির করতে করতে মহান স্রষ্টার কাছে প্রস্থান করেছেন—একটি দৃশ্য যা মানুষের হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
ত্বকির স্মৃতিচারণ, কৃতিত্ব এবং অকাল মৃত্যু ভবিষ্যত প্রজন্মকে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি উৎসাহিত করবে। তাঁর অবদান চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এম আর এম – ২০০১,Signalbd.com



