বাংলাদেশ

উত্তরায় যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনা, নিহত ৬, আহত ৭০

Advertisement

ঢাকার উত্তরায় আজ দুপুরে ঘটল এক ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিজেআই মডেলের প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিধ্বস্ত হয়ে ৬ জন নিহত হয়েছেন এবং ৭০ জন দগ্ধ অবস্থায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছেন।

এই দুর্ঘটনার ফলে গোটা এলাকা জুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আহতদের মধ্যে অধিকাংশই মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মচারী।

কীভাবে ঘটল এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা?

ঘটনাটি ঘটে সোমবার, দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) নিশ্চিত করেছে, যুদ্ধবিমানটি বিমান বাহিনীর এফ-৭ বিজেআই মডেলের প্রশিক্ষণ বিমান ছিল, যা দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়ন করে এবং মাত্র ১২ মিনিটের মধ্যেই দুর্ঘটনার শিকার হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বিমানটি আকস্মিকভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই তলা ভবনে সজোরে আছড়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায় এবং পুরো ভবন মুহূর্তেই দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে।

কলেজের সহকারী অধ্যাপক সবুজ মিয়া সাংবাদিকদের জানান, “স্কুল ছুটির পর অনেক শিক্ষার্থী চলে গেলেও তখনও শতাধিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক ভবনের ভেতরে ছিল।”

তড়িৎ উদ্ধার অভিযান: প্রাণপণ চেষ্টা ফায়ার সার্ভিস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। টঙ্গী, উত্তরা, কুর্মিটোলা, মিরপুর, পূর্বাচলসহ আশপাশের স্টেশন থেকে ইউনিটগুলো অংশ নেয়।

এছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর ২টি প্লাটুন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল উদ্ধার ও নিরাপত্তার দায়িত্বে যুক্ত হয়।

দুপুর ১টা ৪৫ মিনিট থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত উদ্ধারকাজ চলতে থাকে। বিকেল ৩টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৬ জনের মৃত্যু নিশ্চিত এবং ৭০ জনের মতো দগ্ধ বা আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

বার্ন ইনস্টিটিউটে জরুরি চিকিৎসা, অধিকাংশই শিক্ষার্থী

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. সামন্ত লাল সেন জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তারা অধিকাংশই শিশু, কিশোর বয়সী শিক্ষার্থী

তিনি বলেন, “আমরা সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছি। বার্ন ইউনিটে ৭০ জন ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেরই ৩০%–৭০% দেহ পুড়ে গেছে।”

নিহতদের মধ্যে কারা রয়েছেন?

তখন পর্যন্ত নিহতদের পরিচয় প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। আইএসপিআর জানিয়েছে, বিমানের পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির-এর খোঁজ পাওয়া যায়নি।

বিমানটিতে তিনি একাই ছিলেন বলে জানানো হয়, তবে এখনও তার অবস্থা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রে ধারণা করা হচ্ছে, হয়ত তিনি শেষ মুহূর্তে বিমানটি জনবহুল এলাকা থেকে দূরে সরাতে চেষ্টা করছিলেন এবং এজন্যই সময়মতো বের হতে পারেননি।

বিমানটি কীভাবে বিধ্বস্ত হলো? শুরু হয়েছে তদন্ত

বিমান বিধ্বস্তের প্রকৃত কারণ এখনও জানা যায়নি। আইএসপিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইতোমধ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB) এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যৌথভাবে ঘটনাটি তদন্ত করছে।

তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, প্রযুক্তিগত ত্রুটি অথবা পাখির ধাক্কা (bird strike) এর সম্ভাবনা রয়েছে।

স্থানীয়দের চোখে বিভীষিকার দৃশ্য

উত্তরার স্থানীয় বাসিন্দা শাহেদ আলী বলেন, “বিমানটা অনেক নিচু দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে প্রচণ্ড শব্দ হলো। দেখি আগুন আর ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার। এই দৃশ্য আমি সারাজীবন ভুলতে পারবো না।”

একজন নারী অভিভাবক, যিনি শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিতে স্কুলে এসেছিলেন, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার মেয়েটা তখন ভেতরে ছিল। এখনো তাকে পাইনি…”

জাতীয় শোক ও সমবেদনা জানালেন প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি

ঘটনার পরপরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাষ্ট্রপতি সালাহউদ্দিন আহমেদ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তারা আহতদের উন্নত চিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছেন এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “একটি প্রশিক্ষণ বিমান এমন দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হওয়া অত্যন্ত উদ্বেগজনক। দ্রুত তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা হবে।”

পূর্বেও ঘটেছে এমন দুর্ঘটনা

বাংলাদেশে সামরিক বিমানের দুর্ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগে ২০২১ সালের জুলাই মাসে চট্টগ্রামের পটিয়ায় একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। তবে সে ঘটনায় বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আধুনিক যুদ্ধবিমান ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর ওপর দিয়ে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট চালানোর বিষয়েও পুনর্বিবেচনা দরকার।

কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব?

এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রযুক্তির ক্ষুদ্রতম ত্রুটিও কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন ও উচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের মাধ্যমেই এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধ সম্ভব।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button