আঞ্চলিক

বরিশালে ধর্ষণ মামলায় ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড

Advertisement

বরিশালে এক তরুণীকে অপহরণ করে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে চার আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. রকিবুল ইসলাম। রোববার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে এই রায় ঘোষণা করেন তিনি। প্রায় ৯ বছর ধরে চলা মামলার যুক্তিতর্ক ও সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত চার আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।

রায়ের বিস্তারিত ও আসামিদের পরিচয়

দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন মো. গাজী রাসেল (৩৫), মো. রাজিব জমাদ্দার (২৫), মো. জাহিদ হাওলাদার (২৬) এবং মো. রোকন খান (২৩)। এর মধ্যে রোকন খান পলাতক রয়েছেন। রায়ের সময় বাকি তিন আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে অতিরিক্ত কারাদণ্ডের নির্দেশও দিয়েছেন আদালত।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান মৃধা বলেন, “দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর ভুক্তভোগী পরিবার ন্যায়বিচার পেয়েছে। এটি নারীর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের একটি শক্ত অবস্থান।”

২০১৬ সালের ভয়াবহ রাত

আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় বরিশাল নগরের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এক তরুণী বাড়ি থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে ইজিবাইকে করে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্বামীর কাছে যাচ্ছিলেন। ইজিবাইক চালক কৌশলে তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যান এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। কিছু সময় পর মোটরসাইকেলে করে তিনজন যুবক এসে তাঁকে জোরপূর্বক তুলে নেয়।

তরুণীকে চোখ, মুখ ও হাত বেঁধে শহরের ৩০ গোডাউন এলাকার খ্রিস্টানপাড়ার একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে রাতভর পালাক্রমে ধর্ষণ করা হয়। পরদিন সকালে স্থানীয় লোকজন তাঁকে উলঙ্গ অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশে খবর দেয়। পরে তাঁকে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করা হয়।

মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া

ঘটনার পরদিন তরুণীর মা বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় চারজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও অপহরণের মামলা করেন। তদন্ত শেষে তৎকালীন পরিদর্শক মো. আতাউর রহমান ২০১৭ সালের মে মাসে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

দীর্ঘ নয় বছর ধরে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানি চলে। আদালত মোট ১১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। সাক্ষ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করেন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(৩) ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।

আদালতের পর্যবেক্ষণ: “মানবতাবিরোধী ও নৃশংস অপরাধ”

রায় ঘোষণার সময় বিচারক রকিবুল ইসলাম বলেন, “এই ঘটনার নৃশংসতা মানবতার সীমা অতিক্রম করেছে। ভুক্তভোগীর জীবনে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া ছাড়া বিকল্প ছিল না।”

আদালত আরও উল্লেখ করেন, নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণ এখনো সমাজের গভীরে প্রোথিত। তাই এই রায় ভবিষ্যতে অন্যদের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করবে।

ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতিক্রিয়া: চোখে জল, মনে স্বস্তি

রায় ঘোষণার পর আদালত প্রাঙ্গণে ভুক্তভোগীর পরিবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। দীর্ঘ নয় বছর ধরে আদালত ও থানায় ঘুরে ঘুরে বিচার চেয়ে ক্লান্ত পরিবার অবশেষে স্বস্তি প্রকাশ করে। ভুক্তভোগীর মা বলেন, “আমরা অনেক কষ্ট করেছি, অপমান সহ্য করেছি। আজ বিচার পেয়ে মনে হচ্ছে আমাদের মেয়ে যেন একটু শান্তি পেল।”

সামাজিক প্রতিক্রিয়া ও সচেতনতার আহ্বান

রায় ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনা তৈরি করেছে। অনেকেই আদালতের এই সিদ্ধান্তকে প্রশংসা করেছেন। নারীবাদী সংগঠন ও মানবাধিকার কর্মীরা জানিয়েছেন, এই রায় নারীর নিরাপত্তা ও বিচারব্যবস্থার প্রতি নতুন করে আস্থা তৈরি করবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে ধর্ষণ মামলায় দণ্ডের হার এখনো অনেক কম। অনেক ভুক্তভোগী সামাজিক লজ্জা ও ভয়ভীতির কারণে মামলা করেন না। তাই সমাজে সচেতনতা ও দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার উপর জোর দিতে হবে।

দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি সমাজে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে

বরিশালের এই মামলার রায় কেবল চারজন আসামির শাস্তি নয়, এটি এক সামাজিক বার্তা—অপরাধ যতই পুরোনো হোক, বিচার একদিন হবেই।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, এমন রায়গুলো কি সমাজে ধর্ষণ প্রতিরোধে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিক শিক্ষা জোরদার না করলে এ ধরনের অপরাধ সম্পূর্ণ নির্মূল করা সম্ভব নয়।

এম আর এম – ১৯৪৯,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button