আঞ্চলিক

পাকা কলা ও ১০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়ে জেলা পরিষদ কর্মকর্তা বদলি

Advertisement

যশোর জেলা পরিষদের উচ্চমান সহকারী আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে ঘুষ ও অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে বদলির আদেশ দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রোববার (২৬ অক্টোবর) যশোর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত দুদকের গণশুনানিতে অভিযোগ স্বীকারের পরপরই এই নির্দেশ দেন কমিশনার মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী।

অভিযোগকারী রুস্তম আলীর দাবি, আলমগীর হোসেন তাঁর কাছ থেকে পাকা কলা ছাড়াও নগদ ১০ হাজার টাকা ঘুষ নেন। পরে আরও ৬ লাখ টাকা দাবি করেন। অভিযোগকারীর ভাষ্য অনুযায়ী, দাবিকৃত অর্থ না দেওয়ায় ওই কর্মকর্তা তাঁর জমির ডিসিআর অন্য একজনের নামে হস্তান্তর করে দেন।

গণশুনানিতে ঘটনাটির উদ্ঘাটন

‘রুখব দুর্নীতি, গড়ব দেশ; হবে সোনার বাংলাদেশ’ শীর্ষক গণশুনানিতে ঘটনাটি প্রকাশ পায়। যশোর জেলা প্রশাসন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সহযোগিতায় দুদকের আয়োজনে এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন দুদকের চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমেন, কমিশনার মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী, জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলামসহ বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

মোট ৩৭টি দপ্তরের ৭৫টি অভিযোগের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। শুনানির সময় অভিযোগকারী রুস্তম আলী যখন বিষয়টি তুলে ধরেন, তখন কমিশনার সরাসরি আলমগীর হোসেনকে জিজ্ঞাসা করেন। জবাবে তিনি কাজ করিয়ে দেওয়ার জন্য পাকা কলা গ্রহণের কথা স্বীকার করেন।

দুদক কমিশনার তাৎক্ষণিকভাবে তাঁকে বদলির নির্দেশ দেন এবং অভিযোগের অন্যান্য দিক তদন্তের নির্দেশ দেন।

দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্য: “দুর্নীতি কমানোই এখন মূল লক্ষ্য”

দুদক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমেন শুনানিতে বলেন, “দুর্নীতি একেবারে নির্মূল করা সম্ভব না, কিন্তু কমানো সম্ভব। আমরা জনগণ ও কর্মকর্তাদের মুখোমুখি করে তাদের মধ্যে সম্পৃক্ততা তৈরি করছি। এর ফলে দুর্নীতির প্রবণতা কমবে।”

তিনি আরও বলেন, “যতই সময় যাচ্ছে, দুর্নীতির ধরন বদলে যাচ্ছে। এখন ঘুষ নেওয়ার পদ্ধতিও নতুন রূপ নিচ্ছে। যশোরে এসে আমরা এমন এক উদাহরণ শুনলাম যেখানে ঘুষ হিসেবে কলা নেওয়া হয়েছে—এটি যেমন হাস্যকর, তেমনি দুঃখজনক।”

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, “সামনে জাতীয় নির্বাচন। এখন সময় সৎ প্রার্থী নির্বাচনের। দুর্নীতির কারণে বিগত সরকার জনগণের আস্থা হারিয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতি সুবিচার করতে হলে দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্বকে বেছে নিতে হবে।”

অভিযোগকারীর বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া

অভিযোগকারী রুস্তম আলী বলেন, “আমি জমির ডিসিআর পাওয়ার জন্য জেলা পরিষদে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন প্রথমে পাকা কলা চাইলেন, পরে ১০ হাজার টাকা নিলেন। এরপর আরও ৬ লাখ টাকা দাবি করেন। আমি টাকা না দিলে অন্যের নামে ডিসিআর দিয়ে দেন।”

তিনি বলেন, “আমি বিষয়টি দুদকে জানাই, এবং আজ শুনানিতে সত্য প্রমাণিত হলো। আমি চাই, এই ধরনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”

গণশুনানি ও দুদকের উদ্যোগ

দুর্নীতি দমন কমিশন দেশের বিভিন্ন জেলায় ধারাবাহিকভাবে গণশুনানি আয়োজন করছে। এসব শুনানিতে নাগরিকেরা সরাসরি অভিযোগ জানান, এবং দুদক কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

দুদক সূত্র জানায়, গণশুনানির উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারি সেবাখাতে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। এর মাধ্যমে অনেক অভিযোগের তাৎক্ষণিক সমাধানও সম্ভব হচ্ছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধে সচেতনতা ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ

দুদক কর্মকর্তারা জানান, ভবিষ্যতে যেন এমন ঘটনা আর না ঘটে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নৈতিকতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও মনিটরিং জোরদার করা হবে।

জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম বলেন, “এ ধরনের গণশুনানি প্রশাসন ও জনগণের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যারা দুর্নীতিতে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

জনমনে প্রতিক্রিয়া

ঘুষ হিসেবে পাকা কলা গ্রহণের বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। অনেকে বিষয়টিকে “দুর্নীতির নতুন রূপ” বলে আখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, “ঘুষ যতই ছোট হোক, এটি অনৈতিক ও দণ্ডনীয় অপরাধ।”

সাধারণ নাগরিকরা মনে করছেন, দুদকের এমন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা জনগণের আস্থা বাড়াবে। তবে তারা চান, শুধু বদলি নয়, প্রকৃত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক, যাতে ভবিষ্যতে কেউ একই কাজ করতে সাহস না পায়।

দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টায় নতুন দৃষ্টান্তফ

বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনাটি বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোতে দুর্নীতির বাস্তব চিত্র প্রকাশ করে। তবে একই সঙ্গে এটি দেখায়, রাষ্ট্রীয় সংস্থা দুদক এখন আরও সক্রিয় ও জনমুখী হচ্ছে।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শুধু শাস্তি নয়, দুর্নীতির মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। নাগরিক অংশগ্রহণ ও সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়লেই দুর্নীতির হার কমানো সম্ভব।

যশোরে জেলা পরিষদ কর্মকর্তার পাকা কলা ও ঘুষ নেওয়ার এই ঘটনা প্রশাসনে দুর্নীতির গভীর শেকড়ের প্রমাণ হলেও, দুদকের দ্রুত পদক্ষেপ একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, বদলির পর আলমগীর হোসেনের বিরুদ্ধে আরও কী ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং ভবিষ্যতে এমন অনৈতিক আচরণের পুনরাবৃত্তি কতটা ঠেকানো যায়।

এম আর এম – ১৯৪৭,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button